ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কৃষিকাজ : উপার্জনের মাধ্যম ও সওয়াবের ভান্ডার

মাসূদ বিন তাজিম
কৃষিকাজ : উপার্জনের মাধ্যম ও সওয়াবের ভান্ডার

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বা কৃষির সঙ্গে জড়িত। রবি ও খরিপসহ অন্যান্য শস্য বা ফসল উৎপাদনই মূলত সরাসরি কৃষিকাজ বলে পরিচিত। একইভাবে হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য চাষ, ফুল ও ফলের বাগান, কুটির শিল্প ইত্যাদির প্রতিটি একেকটি কৃষিজাতকর্মও জীবিকা নির্বাহের অন্যতম হালাল মাধ্যম।

কৃষিকাজ সম্পাদনের জন্য মাটি বা জমিনসহ যাবতীয় উপায় ও উপকরণ ব্যবহারের বর্ণনা ও নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। যেমন কৃষি কাজের প্রধান উপাদান মাটির ব্যাপার মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনিই তোমাদের জন্য মাটিকে ব্যবহারের উপযোগী করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা এতে বিচরণ করো এবং তাঁর দেওয়া রিজিক আহার করো। আর পুনরুত্থান তাঁর কাছেই হবে।’ (সুরা মুলক : ১৫)।

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার জনপদগুলো আবাদ কর। যাতে এগুলোর মাধ্যমে আমার বান্দারা জীবনযাপন করতে পারে।’ (মাবসুত, ২৩ তম খণ্ড, কিতাবুল মুয়াবিয়া)। আবার হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন ভান্ডারে খাদ্য অম্বেষণ করো।’ (মুসলিম : ২৩)।

আবাদের পর ফল বা ফসল সংগ্রহ, ভক্ষণ, সংরক্ষণ ও দানের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। যেমন কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন এমন বাগানগুলো, যার কিছু মাচায় তোলা হয় আর কিছু তোলা হয় না এবং খেজুর গাছ ও শস্য, যার স্বাদ বিভিন্ন রকম, যায়তুন ও আনার যার কিছু দেখতে একরকম, আর কিছু ভিন্ন রকম। তোমরা তার ফল থেকে আহার কর, যখন তা ফলদান করে এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও। আর অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আনয়াম : ১৪১)।

কৃষিকাজের গুরুত্ব

কৃষি কাজের গুরুত্ব এতই বেশি যে, মহান আল্লাহতায়ালা প্রায় সব নবী ও রাসুলকে দিয়ে একাজ করিয়েছেন। আদি পিতা হজরত আদমকে (আ.) আল্লাহতায়ালা কৃষিকর্ম, উৎপাদন ও ব্যবহার এবং কুটির শিল্পের বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। শুধু আদম (আ.) নয়, প্রায় সব নবী-রাসুলই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যেমন নবীজি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহতায়ালা এমন কোনো নবী পাঠাননি, যিনি বকরি চরাননি। তখন তাঁর সাহাবিরা বলেন, আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি কয়েক কিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরাতাম।’

অর্থাৎ অন্যান্য নবী-রাসুলের মতো আমাদের নবীজিও (সা.) কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছেলেবেলায় তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে বাগানে কাজ করেছেন। নবুয়তের পরও খেজুর বাগান করে আয়-উপার্জন করতেন। আল্লামা সারাখশী (রহ.) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে- তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ‘জারেক’ নামক স্থানে নিজে ফসলাদি আবাদ করেছেন।’ (মাসবূত, ২৩ তম খণ্ড, পৃ.২, কিতাবুল মুয়াবিয়া)।

মোটকথা কৃষি কাজের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, বিশ্বনবী (সা.) নিজে কৃষিকাজ করেছেন এবং তার উম্মতদের নানাভাবে কৃষিকাজের প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছেন। যেমন হাদিসে এসেছ নবীজি (সা.) বলেন, ‘এটা দুর্ভিক্ষ নয় যে, তোমরা বৃষ্টি পাও না বরং এটা দুর্ভিক্ষ যে, তেমরা বৃষ্টির ওপর বৃষ্টি পাও অথচ ভূমিতে কিছু জন্মায় না।’ (মুসলিম)।

কৃষির প্রতি গুরুত্বারোপকরত নবীজি (সা.) এ ব্যাপারে কড়া নির্দেশনা জারি করেছেন যে, কোনো ভূমি যেন পরিত্যক্ত বা অনাবাদি না থাকে। সেজন্য তিনি বলেছেন, ‘যার কাছে জমি আছে সে যেন তা (নিজে) চাষাবাদ করে। যদি সে (নিজে) চাষাবাদ না করে তবে যেন তার কোনো ভাইকে চাষাবাদ করতে দেয়।’ (মুসলিম)। নবীজি (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অনাবাদি জমি আবাদ করে, যা অন্যের নয়, তাহলে সে-ই (ওই জমির মালিকা হওয়ার) বেশি হকদার।’ (বোখারি)।

কৃষিকাজের ফজিলত

কৃষিজাত খাদ্য বা পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষের কেবল খাদ্য চাহিদাই পূরণ হয় না বরং এতে অসংখ্য সওয়াবও অর্জিত হয়ে থাকে। যেমন হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলিম ফলদ বৃক্ষ রোপণ করবে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্য দানস্বরূপ, যা কিছু চুরি হয় তাও দানস্বরূপ, বন্যজন্তু যা খেয়ে নেয় তাও দানস্বরূপ। পাখি যা খেয়ে নেয়, তাও দানস্বরূপ। আর কেউ কিছু নিয়ে গেলে তাও তার জন্য দানস্বরূপ। (মুসলিম : ১৫৫২)।

আরেকটি হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান গাছ লাগায় কিংবা ফসল ফলায়, অতঃপর কোনো পাখি বা মানুষ কিংবা কোনো চতুষ্পদ জন্তু তা থেকে ভক্ষণ করে, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে বিবেচ্য হবে।’ (বোখারি)। আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) বলেছেন, বৃক্ষ রোপণকারী এবং ফসল উৎপাদনকারী এই কাজের দ্বারা সওয়াব লাভের নিয়ত না করলেও সে সওয়াব পেতে থাকে। এমনকি সে যদি বৃক্ষ রোপণ করে এবং ফসল উৎপাদন করে বিক্রি করে দেয়, তবু তার তরফ থেকে সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা তার এই কাজের ফলে আল্লাহর সৃষ্ট জীবের জীবিকা বৃদ্ধি পেয়েছে।’ (বোখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থ, আইনী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৭১১)।

আরেকটি হাদিসের বর্ণনা হলো, নবী (সা.) বলেন, ‘তুমি নিজে যা খাবে তা তোমার জন্য সদকা। তুমি তোমার সন্তানকে যা খাওয়াবে তা তোমার জন্য সদকা। তুমি তোমার স্ত্রীকে যা খাওয়াবে তা তোমার জন্য সদকা। তুমি তোমার চাকরকে যা খাওয়াবে তা তোমার জন্য সদকা।’ (মুসনাদু আহমাদ ইবন হাম্বাল, হাদিস নম্বর-১৭২১৮)।

অর্থাৎ উপরিউক্ত হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায় যে, যেকোনো হালাল মাধ্যমে যে কোনো হালাল পণ্য বা উপকরণ নিজে খেলে বা ভোগ করলে অথবা পরিবারকে ভোগ করালে বা বৈধ অর্থ-সম্পদ পরিবারের জন্য ব্যয় করলে তা নির্দিষ্ট কর্তার জন্য সদকাস্বরূপ। একইভাবে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে কোনো কৃষক বা মানুষ যে কোনো ফল বা ফসলের গাছ রোপণকরত সে ওই বৃক্ষ বা আবাদ থেকে নিজে যতটুকু ভক্ষণ বা ভোগ করবে ততটুকু তার জন্য সদকাস্বরূপ। আবার স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারকে যতটুকু খাওয়াবে ততটুকু তার জন্য সদকা। আবার ওখান থেকে যতটুকু দান করবে সবটুকু তার জন্য সদকাস্বরূপ। যতটুকু চুরি হবে তাও তার জন্য সদকা। এমনকি টাকার জন্য যতটুকু বিক্রি করবে সেটুকুও তার জন্য সদকাস্বরূপ।

শুধু তাই নয়, ইসলামি আদর্শে আদর্শিত একজন কৃষক যতদিন রুজি-রোজগারের জন্য কৃষিকাজ করে বা করবে, ততদিন সে যেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে থাকে। এ ব্যাপারে রাসুুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য হালাল রুজি উপার্জনে ব্যপৃত থাক; কেননা তা নিশ্চয়ই আল্লাহর রাহে জিহাদ করার মতই।’ (তাবারানি, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ)।

সুতরাং মৌলিক ইবাদতগুলো আদায় করত কেউ যদি কৃষি কাজ করে তবে সেটিও ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। তবে ইসলামি দিকনির্দেশনা না মেনে কৃষি বা কৃষিজাত কর্ম করে উপার্জন করলে সে উপার্জনের পুরো অংশ বা নির্দিষ্ট অংশ হারাম হয়ে যেতে পারে। যেমন কৃষিজীবীদের মধ্যে অনেক কৃষক আছেন, যারা অন্যের জমির আইল ঠেলেন বা আইলঘেঁষা জমির কিছু অংশ নিজের দখলে নিতে চান। এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কারণ যে অংশটুকু ভোগ করবে (তা যত সামান্যই হোক) কেয়ামতের দিন তাকে সে অংশটুকু কাঁধে বহন করে উঠতে হবে। অনেকেই উৎপাদিত ফসল জমিতে বা বাজারে নিয়ে বিক্রির সময় ওজনে কম দেন। অনেকে বস্তা বা বড় প্যাকেটের নিচের দিকে অর্ধপচা বা খারাপ দ্রব্য দেন এবং দাম নেওয়ার সময় ভালো দ্রব্যের মান অনুযায়ী ওই পচা বা খারাপ অংশটুকুরও সমান দাম নেন, যা নিষিদ্ধ বা হারাম।

গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে (কমবেশি) পশুপাখি পালন করা হয়। অনেকে এ ক্ষেত্রেও অবৈধ উপায়ের আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ অল্প সময়ের মধ্যে বাড়তি টাকা আয়ের জন্য কৃত্রিম ও অবৈধ উপায়ে পশুকে মোটাতাজা করে বিক্রি করেন। যারা গাভি পালন করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সে গাভির দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করে আয় করেন, যা বৈধ নয়। কৃষিক্ষেত্র থেকে উপার্জনের বেলায়ও এভাবে অনেকেই অবৈধ কাজ করেন। এসব কারণে হয়তো মোট উপার্জন হারাম হয় না; কিন্তু নির্দিষ্ট অংশ তো হারাম হয়ই। আর ওই অংশটুকুই পরিত্যাগ করা আবশ্যক।

সুতরাং মাটি বা জমিনে বৈধ উপায়ে যে কোনো বৈধ ফল বা ফসল আবাদ করাসহ অন্যান্য কৃষিজাত কর্ম করা এবং এগুলোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা মহান আল্লাহতায়ালা ও রাসুলের (সা.) নির্দেশিত, সম্মানিত ও মহিমান্বিত পেশা বা উপায়।

লেখক : ইসলামিক কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত