ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শালীন পোশাক সভ্যতার পরিচায়ক

মোহাম্মদ এনামুল হক
শালীন পোশাক সভ্যতার পরিচায়ক

পোশাক ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য, সভ্যতা ও লজ্জাশীলতার পরিচায়ক। মানুষ পোশাক পরিধানের তাগিদ অনুভব করেছিল সেই আদিম আমলেই। আদিম থেকে আধুনিক- সব যুগেই আছে পোশাকের কদর। হোক না তা গাছের পাতা কিংবা সুতায় বোনা কাপড়। তাই লাজুকতায় বশীভূত হয়ে লজ্জাস্থান ঢাকার প্রবণতা প্রাকৃতিক। মানুষ বিবস্ত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু নগ্নতার চাদর ছুড়ে ফেলে খুব শিগগির সে নিজেকে পোশাকের আবরণে ঢেকে ফেলে। এ চেতনাবোধ স্বভাবজাত, যা মানুষকে অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করেছে। নগ্নতা বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে পশু-পাখি এবং মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। মানুষ নিজেদের শরীরকে কাপড় দিয়ে আবৃত করে রাখে, পক্ষান্তরে অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পোশাককেন্দ্রিক কোনো চেতনার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে তার গুপ্তাঙ্গ প্রদর্শনে লজ্জাবোধ করে। ‘লজ্জা’ নামক বৈশিষ্ট্যটিও কেবল মানুষের জন্য বিশেষায়িত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে লজ্জাবোধে নিজেদের শরীর আবৃত রাখাকে মানবীয় প্রবৃত্তি বলা যায়।

কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কর্মসূচি পালন করেছে ঢাবির কিছু শিক্ষার্থী। এ সময় তারা ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়’, ‘পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ হোক’ প্রভৃতি লেখা সংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে। এই মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, গত ১৬ আগস্ট একটি মামলার পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত পোশাকের স্বাধীনতার নাম দিয়ে যারা পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। আদালত প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি-না? কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার আছে। পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। আর তাদের এই মানববন্ধন ও প্ল্যাকার্ডের সঙ্গে আমিও সমর্থন প্রদর্শন করছি। তাছাড়া দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী পোশাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায়, উচ্চ আদালতকে অভিবাদন ও স্যালুট জানাচ্ছি।

কোনো এক লেখিকা গত ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ খবর পত্রিকায়’ লেখার ভেতরে পোশাক নারীর স্বাধীনতার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এত বড় বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা কেন মানববন্ধন করছেন! এর প্রতি উত্তর হচ্ছে, একজন মোমিন হিসেবে কোনোভাবেই এটা মেনে নেওয়া কাম্য নয়। আর বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য নারীরা বোঝেই না, কীসে তার সম্মান-ইজ্জত ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফিকাহশাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘রদ্দুল মুহতারে’ বলা হয়েছে : ‘পোশাক তাকেই বলা হয়, যা লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখে।’ ন্যূনতম এতটুকু পরিমাণ পোশাক পরিধান করা ফরজ। কোরআনের ভাষ্য থেকেও পোশাকের এ সংজ্ঞা বোঝা যায়। কোরআন বলছে : ‘এ পোশাক তোমাদের লজ্জাস্থান আচ্ছাদিত করে ফেলে।’ (সুরা আরাফ : ২৬)

ইসলামি শরিয়তে পোশাক বলতে ওই বস্ত্রখণ্ডকে বোঝায়, যা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলে। যে পোশাক লজ্জাস্থানকে পুরোপুরি আবৃত করে না কিংবা এতই সূক্ষ্ম, মসৃণ, পাতলা ও সংকীর্ণ হয় যে, এর ফলে ঢেকে রাখা অঙ্গ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়, ইসলাম এমন বস্ত্রকে পোশাক বলেই স্বীকৃতি দেয় না। এরই সঙ্গে আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে কিছুতেই ইসলামের সীমারেখা অতিক্রম করা যাবে না। পোশাকের রং, গুণ-বৈশিষ্ট্য, পরিধানের ধরন ও পদ্ধতিতে যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, কিছুতেই সেগুলোর ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।

একটি সুন্দর শালীন পোশাক মানুষকে দৃশ্যত সত্যিই আরো সুন্দর ও মুগ্ধ করে তোলে। ইসলাম হচ্ছে চিরকালের আধুনিক। তার আধুনিকতা সর্বজনীন। এর সৌন্দর্যের আবেশ ছড়িয়ে আছে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস সে পোশাকেও রয়েছে ইসলামের সৌন্দর্য ও আধুনিকতা। আজকাল সমাজের অনেকাংশেই আধুনিক পোশাকের নামে যেসব উদ্ভট ও উৎকট পোশাক পরিধান করে, অবশ্যই তা শালীনতাবোধের আওতাধীন নয়। ছেড়া প্যান্ট, ফাটা গেঞ্জি, বুক-পিঠ দেখানো বিজাতীয় কালচারের লেডিস জামা-কাপড় কোন প্রকারের শালীনতা আর ভদ্র পোশাকের অন্তর্ভুক্ত এটা! ইসলাম কখনোই কোনো প্রকার প্রান্তিকতার দিকে আহ্বান করে না বরং এর ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারই সবকিছুর মৌলিক মানদ-। আর এ পোশাকের বেলায়ও ইসলাম তার সৌন্দর্য ও সঠিকতার মানদ- বর্ণনা করে দিয়েছে।

নারী-পুরুষ একে অপরের মতো হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোশাক যারা পরে, তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা রাসুলের হাদিসে দেখতে পাই, রাসুল (সা.) অভিসম্পাত করেছেন ওই পুরুষকে, যে মহিলার পোশাক পরে এবং ওই মহিলাকে, যে পুরুষের পোশাক পরে। (সুনানে আবু দাউদ : ৪০৯৮)।

এছাড়া হিন্দু ধর্মেও পোশাকের বিষয়ে অনেক শালীনতার কথা বলা হয়েছে, ঋগবেদ অধ্যায় নম্বর ৮ অনুচ্ছেদের ৩৩ পরিচ্ছেদ ১৯-এ বলা হয়েছে- যেহেতু ব্রহ্মা তোমাদের নারী করেছেন তাই দৃষ্টিকে অবনত রাখবে, উপরে নয় নিজেদের পা সামলে রাখো। এমন পোশাক পরো, যাতে কেউ তোমার দেহ দেখতে না পায়।

ঋগবেদ, গ্রন্থ নম্বর ১০, অনুচ্ছেদ ৮৫, পরিচ্ছেদ ৩০-এ বলা হয়েছে- সেই লোককে কেউ পছন্দ করে না যে তার নিজের স্ত্রীর পোশাক দিয়ে নিজের উরু ডেকে রাখে। অর্থাৎ কোনো মানুষ তার বিপরীত লিঙ্গের মানুষের পোশাক পরা নিষিদ্ধ।

কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার নামে কিছু মানুষ পোশাকের গুরুত্বকে অস্বীকার করে নিজেদের জন্তু-জানোয়ারের শ্রেণিতে অধঃপতিত করছে। যৌনাঙ্গের উন্মুক্ত প্রদর্শনের স্বাধীনতা তারাই দাবি করে, যাদের মধ্যে লজ্জাবোধ নেই। মূলত তারা তাদের স্বকীয়তাকে অস্বীকার করছে। মানুষের মধ্যে লজ্জাবোধ উঠে গেলে মানুষ বেহায়াপূর্ণ-অশ্লীল যেকোনো কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। নির্লজ্জ মানুষের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব। সে কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। অন্যদিকে লজ্জা মানুষকে অনেক খারাপ কর্ম থেকে বিরত রাখে। লজ্জা মানুষের আত্মমর্যাদার ভূষণও বটে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত