ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামিক দৃষ্টিকোণে পোশাকের গুরুত্ব ও শিষ্টাচার

মুহাম্মদ নাহিদ হোসেন নাঈম
ইসলামিক দৃষ্টিকোণে পোশাকের গুরুত্ব ও শিষ্টাচার

মানুষ সভ্য জীব। আর সভ্যতার অন্যতম পরিচায়ক হচ্ছে শালীনতা। অশালীন চালচলন সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা কোনো সমাজেই শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সভ্য জীব হিসেবে মানুষের সভ্যতার অন্যতম বাহন হচ্ছে পোশাক বা পরিচ্ছদ। শুধু লজ্জা নিবারণই নয়, একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, তার শালীনতাবোধ এবং সামাজিক অবস্থান অনেকটাই নির্ভর করে তার পোশাকের ওপর। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদিম গুহাবাসী মানুষ একদা বন্য পশুর মতোই দিগম্বর ছিলেন। খাদ্য অন্বেষণে যাযাবর মানুষ ক্রমে পশুপালন ও চাষাবাদ ব্যবস্থা প্রচলনের পর্যায়ে মানবিক চিন্তা-চেতনা ও বিবেক-বুদ্ধির বিকাশে সমাজ, গ্রাম ও লোকালয়ের পত্তন শুরু করেন।

আর এ পর্যায়ে লজ্জা-শরমের বিষয়টি অনুভূত হওয়ায় আদিম মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের লতাপাতা, ছাল-বাকল, পশুপাখির চামড়া ও পালক পরিধান করতে শুরু করে। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা অধিক করুণ। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা লুণ্ঠনের ফন্দি-ফিকিরের জন্য বিকৃত রুচির পোশাকের কাটতি বাড়াতে ফ্যাশন নাম দিয়ে তা করা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এর অনুকরণ-অনুসরণ সবদিক থেকে অকল্যাণকর। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখতে হবে। যে পোশাক আদিম মানুষকে সভ্যতায় উন্নীত করেছে, আধুনিক ফ্যাশনের নামে তার ডিজাইন যদি পুনঃ মানুষের আদিমতাকেই উস্কে দেয়, তা কোনোভাবে রুচিশীল, মার্জিত পোশাক বলে বিবেচিত হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, পোশাক শুধু জীবনে নয়, মরণেও থাকবে।

পোশাক-পরিচ্ছদ মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম অনুষঙ্গ। দেহ সজ্জিত করা এবং সতর (শরীর) আবৃত করার প্রয়োজনীয় মাধ্যম। তা ছাড়া এটি ব্যক্তিত্ব প্রকাশেরও অনন্য উপকরণ। কোরআন মাজিদের এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা পোশাকের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি, তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দোষণীয়, তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যেরও উপকরণ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই সর্বোত্তম। এসব আল্লাহর নির্দেশনাবলির অন্যতম, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা আরাফ : ২৬)। নিম্নে পেশাক পরার শিষ্টাচার তুলে ধরা হলো :

সতর আবৃত করা

পোশাক-পরিচ্ছদ এমন হতে হবে, যা পুরো সতর আবৃত করে। পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর পুরো শরীর সতর। পোশাকের মূল উদ্দেশ্যই সতর ঢাকা। পোশাক প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি পোশাক, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং সৌন্দর্য দান করে।’ (সুরা আরাফ : ২৬)। সুতরাং যে পোশাক এই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ, তা যেন শরিয়তের দৃষ্টিতে পোশাকই নয়!

নারী-পুরুষ স্বতন্ত্র পোশাক পরিধান করা

হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) অভিসম্পাত করেছেন ওই পুরুষকে, যে নারীর পোশাক পরে এবং ওই নারীকে যে পুরুষের পোশাক পরে। (আবু দাউদ : ৪০৯৮)।

খ্যাতির আশায় পোশাক না পরা

প্রতি ঈদ বাজারে পোশাক কারখানাগুলো পরিচিত মডেল এবং টিভি সিরিয়ালের নামে বাহারি পোশাক বাজারজাত করে থাকে। আর উঠতি ছেলেমেয়েদের এসব পোশাকের প্রতি থাকে বাড়তি আগ্রহ। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) এসব পোশাক না পরার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় প্রসিদ্ধির পোশাক পরবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। অতঃপর তাকে অগ্নিদগ্ধ করা হবে। ’ (আবু দাউদ : ৪০২৯)।

পোশাক পরিধানে কৃপণতা না করা

অপচয় ও কৃপণতা সর্বক্ষেত্রেই নিন্দনীয়। পোশাক-পরিচ্ছদেও এর ব্যতিক্রম নয়। সামর্থ্য থাকার পরও কেউ যদি কৃপণতা করে নিম্নমানের পোশাক পরিধান করে ইসলামে তাদের অপছন্দ করা হয়েছে। একবার আবুল আহওয়াসের পিতা মালিক বিন আউফ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন। তখন তার পরনে ছিল অতি নিম্নমানের পোশাক। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি সম্পদ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, কী সম্পদ আছে? তিনি বললেন, সব ধরনের সম্পদই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, গোলাম ইত্যাদি। তখন তিনি এরশাদ করলেন, ‘যখন আল্লাহতায়ালা তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন, তখন তোমার ওপর তার নেয়ামতের ছাপ থাকা চাই।’ (নাসাঈ : ৫২৯৪)।

পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখা

পোশাক-পরিচ্ছদ দ্বারা সতর আবৃত করার পাশাপাশি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিপাটি রাখা ইসলামের নির্দেশনা। সাহল বিন হানজালিয়া (রা.) বলেন, কোনো এক সফর থেকে ফেরার পথে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবাদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভাইদের কাছে আগমন করছ। সুতরাং তোমাদের হাওদাগুলো গুছিয়ে নাও এবং তোমাদের পোশাক পরিপাটি করো, যাতে তোমাদের (সাক্ষাৎ করতে আসা) মানুষের ভিড়ে তিলকের মতো (সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন) মনে হয়। (জেনে রেখো) আল্লাহতায়ালা স্বভাবগত নোংরামি বা ইচ্ছাকৃতভাবে নোংরা থাকা, কোনোটাই পছন্দ করেন না।’ (আবু দাউদ : ৭০৮৩)।

প্রদর্শনের মানসিকতা পরিহার করা

অহংকার বা মানুষ দেখানোর মানসিকতা সর্বাবস্থায় সব কাজেই নিন্দনীয়। পোশাক-পরিচ্ছদের মাধ্যমেও যেন এই ব্যাধি মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও হাদিস শরিফে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না (রাগান্বিত থাকবেন)। (বোখারি : ৫৭৯১)।

বিধর্মীদের পোশাক না পরা

বিধর্মীদের অনুকরণে পোশাক পরিধান করা নাজায়েজ। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অমুসলিমদের পোশাক পরবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (তবারানি আওসাত : ৩৯২১)। আল্লাহতায়ালা আমাদের পোশাকের প্রতি যত্নবান হওয়ার তৌফিক দান করুন।

লেখক : ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত