পৃথিবীতে মহান আল্লাহতায়ালার দেওয়া বড় নেয়ামত হলো পিতামাতা। আর পিতামাতার কারণেই একটি সন্তান দুনিয়ার আলো দেখতে পারে। সন্তানের শিশুকাল থেকে শুরু করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত সব স্তরে, সব পর্যায়ে পিতামাতার ভূমিকা অপরিসীম ও অবিস্মরণীয়। পিতামাতা এমন একটি শব্দ, যার সাথে কোনো হিংসা, অহংকার ও সার্থপরতা ইত্যাদি খারাপ গুণাবলি সংবলিত শব্দের সংমিশ্রণ ঘটে না। পিতামাতা শব্দের সঙ্গে শুধু ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আত্মত্যাগ, সব কিছু বিসর্জন দেওয়ার মতো মনমানসিকতা সম্পন্ন শব্দেরই সংমিশ্রণ ঘটতে পারে। ইসলামে পিতামাতার অধিকার ও তাদের মর্যাদা কতটুকু তা বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহতায়ালা বলেন : তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোােনা কিছুকে শরিক করো না। আর পিতামাতার প্রতি উত্তম আচরণ কর। (সুরা নিসা : ৩৬)।
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন : আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করবে না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩, ২৪)।
অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন : আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।
এই প্রসঙ্গে হাদিসে এরশাদ হয়েছে : আবু আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, যথা সময়ে নামাজ আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (বোখারি : ৫২৭, ২৭৮২, ৫৯৭০, ৭৫৩৪, মুসলিম : ৮৫, তিরমিজি : ১৭৩, ১৮৯৮)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। (বোখারি : ৫৯৭১, মুসলিম : ২৫৪৮, ইবনু মাজাহ : ২৭৩৮, ৩৭০২)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কবিরা গোনাহগুলোর একটি হলো আপন পিতামাতাকে গালি দেওয়া। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! আপন পিতামাতাকে কি কোনো ব্যক্তি গালি দেয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ, সে লোকের পিতাকে গালিগালাজ করে, তখন সেও তার পিতাকে গালিগালাজ করে থাকে এবং সে অন্যের মাকে গালি দেয়, সুতরাং সেও তার মাকে গালি দেয়।
অন্য এক বর্ণনায় আছে, কবিরা গোনাহগুলোর একটি হলো নিজের পিতামাতাকে অভিশাপ করা। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের পিতামাতাকে কীভাবে অভিশাপ করে? তিনি বললেন, সে অপরের পিতাকে গালিগালাজ করে, তখন সেও তার পিতাকে গালিগালাজ করে থাকে। আর সে অন্যের মাকে গালি দেয়, বিনিময়ে সেও তার মাকে গালি দেয়। (বোখারি : ৫৯৭৩, মুসলিম : ৯০, তিরমিজি : ১৯০২, আবু দাউদ : ৫১৪১, রিয়াদুস সলিহীন : ৩৪৩)।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অনেক জায়গায় পিতামাতার মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন : পিতামাতাকে কষ্ট না দেওয়া, বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করা, এমন ব্যবহার করা, যাতে পিতামাতা ‘উফ’ শব্দটিও না করে, সর্বোপরি তাদের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করা ইত্যাদি।
একটি সন্তানকে সমাজের মধ্যে যোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত করতে পিতামাতাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। এরই মধ্যে যেসব পিতামাতা অনেক কষ্ট সহ্য করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, তাদের পক্ষে তাদের সন্তানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সহজ হলেও যেসব পিতামাতা অত্যন্ত দরিদ্র, দিন আনে দিন খায়, সেসব পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তারপরও তারা তাদের সন্তানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সর্বদা তৎপর থাকে। প্রয়োজনে তারা অনেক রাত না খেয়ে কাটালেও তারা তাদের সন্তানদের এটা বুঝতে দেয় না। পিতামাতা নিজের রক্ত বিক্রি করে বা নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে হলেও তাদের সন্তানদের আগলে রাখে। তারা শুধু সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ও তাদের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর জন্য এবং তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, অন্যের বাড়িতে কামলা দিতে, ঠেলাগাড়ি, রিকশা-ভ্যান চালানোসহ নানা ধরনের শত কষ্টের কাজ করতেও দ্বিধা করে না। দিনের আলোর মতো সত্য যে, পিতা-মাতার ঋণ কোনো সন্তানই কোনো দিন শোধ করতে পারবে না। এটাই বাস্তব।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে সন্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পিতামাতার এত কষ্ট, এত আত্মত্যাগের কথা আর মনে রাখে না। শিক্ষিত অথবা প্রতিষ্ঠিত সন্তানরা বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার দায়িত্ব নিতে চায় না। তারা তাদের বোঝা মনে করে। তারা পিতামাতার অসুস্থতা ও তাদের কাছে পিতামাতার চাহিদাগুলোর বহিঃপ্রকাশকে বিরক্তির কারণ মনে করে। একটা সময় দেখা যায়, তারা পিতামাতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করে এবং তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, যা নৈতিকতা বিবর্জিত ও মানবতাহীন কর্মকাণ্ডেরই একটি অংশ। এটা কখনোই কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আরও মারাত্মক সংবাদ পাওয়া যায় যে, সন্তান তাদের পিতাকে অথবা মাতাকে প্রহার করেছে এবং তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদি কোনো ঈমানদার মুসলমানের ওপর তার পিতামাতা সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে আল্লাহতায়ালাও তার ওপর সন্তুষ্ট হন না।
সুতরাং সন্তানদের একটু পিতামাতার আগের ভূমিকা ও তাদের অবদানগুলোকে স্মরণ করা উচিত, পিতামাতা এমন একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যেখানে আশ্রয় নিলে কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকে না। বরং মনের মধ্যে প্রশান্তি লাভ করে এবং মনে নিরাপদ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। পিতামাতা এমন একটি স্বার্থহীন ভালোবাসার কেন্দ্রস্থল, যে ভালোবাসা সব গ্লানি, দুঃখ, কষ্ট ভূলিয়ে দেয়।
একদিন আল্লাহর দেওয়া দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় নেয়ামত পিতামাতা থাকবে না। তখন সন্তানরা বুঝতে পারবে, তারা মাথার ওপরে ছায়াযুক্ত কত বড় বটগাছ হারিয়েছে। তখন আর কিছু করার থাকবে না। তাই সব সন্তানের উচিত পিতামাতার যত্ন নেওয়া এবং বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করা। এর মধ্যেই আল্লাহতায়ালা শান্তির মহাসমাবেশ ঘটাবেন। সন্তানদের যেরকম পিতামাতা কোনো বিপদে ফেলে দিতে পারে না, ঠিক সেরকম সন্তানদের উচিত পিতামাতাকে বিপদে ফেলে না দিয়ে তাদের সেবার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া