ঢাকা সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় আমাদের করণীয়

এসএম আরিফুল কাদের
দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় আমাদের করণীয়

জীবন বাঁচাতে সকল প্রাণীর চাহিদা থাকে। শ্রেণিভেদে তা ভিন্ন হয়। তন্মধ্যে আশরাফুল মাখলুকাত (মানুষ)-এর চাহিদা উল্লেখযোগ্য। তারা অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাব পূরণ করতে সংগ্রামশীল। সে সংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়ে কেউ হয় ধনধান্য, আবার কেউ অকৃতকার্য হয়ে হয় সর্বস্বান্ত। সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর পাশে থেকে সাধ্য অনুসারে সহযোগিতা করলে প্রত্যক্ষভাবে যেমন দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সফল হবো, পরোক্ষভাবেও (পরকালে) থাকবে আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সফলকাম হতে নির্দেশনা তুলে ধরা হলো-

সর্বক্ষেত্রে অপচয় রোধ করা

অপব্যয়কারীকে জীবনে কোনো একসময় কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের বদভ্যাস হলো মিতব্যয়ী না হয়ে অপব্যয়ী হওয়া। স্বীয় প্রতিপত্তি বজায় রাখতে কোনো আয়োজনে প্রয়োজন অতিরিক্ত খাবার নষ্ট করা, পোশাক-গহনা পরিধান করা, বাড়ি-গাড়ি করা, বিদ্যুৎ অপচয় করা ইত্যাদি, যা দিয়ে অভাবীদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। তাই মিতব্যয়ী (অপচয় না করে) হয়ে চলার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করো, খাও ও পান করো এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)। অপব্যয়ীরা শুধু আল্লাহর অপছন্দনীয়ই নয়; বরং শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে- ‘এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়ীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা ইসরা : ২৬-২৭)। অপচয়ের নিকৃষ্ট দিকের নাম অহংকার। ধনাঢ্য বলেই অপচয়। নিঃস্ব হলে কুড়িয়ে নিতে যেমন লজ্জা লাগত না, ঠিক তেমনি মিতব্যয়ী হয়ে খরচ করলে নিঃস্ব হয়ে দ্বারে দ্বারে যেতে হবে না ইনশাআল্লাহ। সে সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) হাদিসে এরশাদ করেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ ফরমান- ‘তোমরা পানাহার করো, দান-খয়রাত করো এবং পরিধান করো। যেন তাতে অপচয় বা অহংকার যুক্ত না হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৬০৫)।

জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি চালু রাখা

মানবকল্যাণ ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্লোগান। সে ধারা অব্যাহত রাখলে যাবতীয় দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ ঠেকানো সম্ভব। আর তা হলো- অন্যান্য ইবাদতের পাশাপাশি জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি চালু রাখা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। তাদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসুলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।’ (সুরা তাওবা ৭১)। স্বাবলম্বীদের সম্পদে ফকির, মিসকিন, গোলাম, ঋণগ্রস্ত ও মুসাফির প্রমুখের আড়াই শতাংশ অধিকার রয়েছে। তা আদায় না করলে একদিকে সম্পদ যেমন পবিত্র হয় না, পক্ষান্তরে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, কোনো জাতি জাকাত না দিলে আল্লাহতায়ালা তাদের দুর্ভিক্ষে নিপতিত করেন।’ (সহিহ আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব : ৭৬৩/মুজামুল আওসাত লিত-তাবরানি : ৪৫৭৭)।

সুদের আদানপ্রদান বন্ধ করা

প্রত্যক্ষ বিলাসিতার আরেক নাম সুদ। চাকচিক্যময় জীবন হঠাৎ ধ্বংস হয়ে যায়। মহান প্রভু এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ সুদকে হ্রাস (দরিদ্রতা) করেন এবং সদকাকে বর্ধিত (অঢেল সম্পত্তি) করেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৬)। সুদ সম্পদের বরকত নষ্ট করে দেয় এবং দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, যে জাতির মধ্যে সুদ প্রসারিত হয়, তারা দুর্ভিক্ষে নিপতিত হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৭৮২২)।

ব্যভিচার বন্ধ করা

উদ্বেগজনক হারে জেনা তথা ব্যভিচার বেড়েই চলেছে। ঘরবাড়ি, পথঘাট এমনকি শিক্ষাঙ্গনে পর্যন্ত এই জাহেলিয়াত বিস্তার করছে। কর্মফল স্বরূপ একের পর এক আজাব-গজব লেগেই থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচারের ব্যাপকতা ঘটলে তারা নিজেরাই যেন হাতে ধরে তাদের ওপর আল্লাহতায়ালার আজাব নিপতিত করল।’ (সহিহ আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব : ২৪০১)। জেনা বা ব্যভিচারে যেসব আজাব আসে, তন্মধ্যে সর্বশেষ হলো- এসব জনপদে দুর্ভিক্ষের প্রসার ঘটবে। হাদিসে এসেছে, হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যভিচারের ব্যাপকতা লাভ করে, তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ শরহে মিশকাতুল মাসাবিহ : ৩৫৮২)। তাই আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে জেনা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন, ‘তোমরা অবৈধ যৌন সংযোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা ইসরা : ৩২)।

নির্ধারিত পরিমাণের (ওজন) কম দেওয়া রোধ করা

বিশ্বস্ততাকে অসহায়ত্ব ভেবে অনুমোদিত বা নির্ধারিত (ওজন/পরিমাণ) পণ্যদ্রব্য ও অর্থ কম দেওয়া সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে আছে। যার কারণে অর্থকষ্ট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘...যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজন/ওয়াদাকৃত (নির্ধারিত অর্থ) কম দেয়। তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে...।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)। মহান প্রভু এ সম্পর্কে এরশাদ করেন, ‘ধ্বংস; যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় (নির্ধারিত) পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে।’ (সুরা মুতাফফিফীন : ১-২)।

বেশি বেশি তওবা (ইস্তেগফার) করা

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তিনি তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা (অসৎ পথ থেকে) ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)। সুতরাং দুর্ভিক্ষকে মোকাবিলা করতে তওবার বিকল্প নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘(আমি) বলেছি! তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল। (তোমরা তা করলে) তিনি অজস্র ধারায় তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন জান্নাত ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।’ (সুরা নুহ : ১০-১২)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত