প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ৩০ নভেম্বর, ২০২২
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যা মানব জীবনের সব গতিপথ-কার্যধারা অন্তর্ভুক্ত করে। এর সোনালি নীতির প্রতি অসন্তোষ-অন্তর্দাহ অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। ইসলাম একটি মধ্যপন্থি ধর্ম, সবকিছুতেই মধ্যপন্থা পছন্দ করে, সমর্থন করে না বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি। ইসলামি ব্যবস্থাপনা অসার-শুষ্ক ব্যবস্থাপনা নয়; যেখানে অবান্তর আনন্দ ও প্রাণবন্ততার কোনো অবকাশ নেই; বরং ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা মানব প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ-সংহত ও প্রাকৃতিক লক্ষ পূরণে যথাযথ-পারফেক্ট। এর মধ্যে স্ব-শৈলীযুক্ত ‘সন্ন্যাসবাদ’ বা অনিয়ন্ত্রিত ধ্যান-জগিংয়ের অনুমতি নেই। সহজসাধ্য-সাবলীল করা এবং কষ্টক্লেশ, ব্যথা-বেদনা থেকে রক্ষা করা শরিয়তের উদ্দেশ্যের শামিল। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজসাধ্য করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না।’ (সুরা বাকারাহ : ১৮৫)।
ইসলামি শিক্ষা একদিকে যেমন আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-উপাসনা, সামাজিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, নীতি-নৈতিকতা ও আচার-আচরণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি তাগিদ করেছে, অন্যদিকে জীবনের সূক্ষ্ম ও ক্ষীণ দিকগুলোও সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর মতো সমগ্র জীবন খেলাধুলায় আবদ্ধ করে রাখা এবং খেলাধুলার জন্যই জীবন এই তত্ত্ব ইসলাম সমর্থন করে না।
ইসলাম মানুষকে উদ্দেশ্যমূলক জীবনযাপনের নির্দেশনা প্রদান করে এবং ক্রীড়ামূলক জীবনের প্রতি নিন্দা পোষণ করে। উদ্দেশ্যমূলক জীবন, যেখানে রয়েছে সর্বদা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ, পরকাল নির্মাণের উদ্বেগ, যে জীবন ঈমানদারদের চিহ্ন-পরিচায়ক। আর যে জীবনের ভিত্তি অবহেলা-উন্মাদনা, অহমিকাণ্ডস্বার্থপরতা ও খেল-তামাশা তা কুফরের চিহ্ন। মহান আল্লাহর বাণী : আর (ঈমানদার তারাই) যারা অযথা কথা-কর্ম পরিহার করে। (সুরা মু’মিন : ৩)।
ইসলাম পরকালের সফলতার প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে এবং পার্থিব-জাগতিক সব স্বার্থের প্রতিও দিয়েছে যথেষ্ট মনোযোগ। ইসলামি শরিয়তে ওইসব কাজই প্রশংসনীয়; যা একজন মানুষকে প্রকৃত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ওইসব কাজের অনুমতি রয়েছে, যার মধ্যে ইহকাল ও পরকালের সুনিশ্চিত উপকার রয়েছে, অন্তত দুনিয়া ও আখেরাতের কোনো ক্ষতি নেই।
ইসলাম অলসতাণ্ডকুড়েমি পছন্দ করে না; বরং পছন্দ করে সজীবতাণ্ডপ্রফুল্লতা। মুসলমান উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মেনে চলবে ইসলামি শরিয়তের সব নিয়মণ্ডনীতি; সংকোচন-সংকীর্ণতার সঙ্গে নয়। অলসতা ও সংকীর্ণতার সঙ্গে ইবাদত করা মুসলমানের প্রক্রিয়া নয় বরং মুনাফেকের পরিচায়ক। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন : ‘তারা (মুনাফেকরা) যখন নামাজের জন্য দাঁড়ায়, তখন তারা অলসভাবে দাঁড়ায়।’ (সুরা আন-নিসা : ১৪২)।
তাই ভদ্রতাণ্ডসভ্যতা, আদব-কায়দা বজায় রেখে নৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে ওইসব প্রাণবন্ততা, উচ্ছলতা, বিনোদন ও খেলাধুলার অনুমোদন রয়েছে, যে খেলাধুলায় ধর্মীয় বা পার্থিব উন্নতি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ রয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে সেখানে ১. সময় অপচয় ২. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা-বিচরণ ৩. নাচণ্ডগান ও অশ্লীলতা ৪. কিছু ক্রীড়াবিদকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন করা ৫. সতর তথা পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঢেকে না রাখা ও নারীর জন্য পুরো শরীর আবৃত করে না রাখা ৬. বাজি, জুয়া, ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট-ফিক্সিংসহ শরিয়তবিরোধী কোনো বিষয় না থাকা। আর যে খেলাধুলায় ধর্মীয় বা জাগতিক উপকারিতাণ্ডলাভ নেই, যে খেলাধুলা নিছক সময় ক্ষয়-নষ্ট করার মাধ্যম, পরকালের প্রতি উদাসীন-নিস্পৃহ কারী বা যে খেলাধুলায় শরিয়ত গর্হিত কাজ-কর্ম রয়েছে সেগুলো নাজায়েজ-অবৈধ। (ইমদাদুল মুফতিয়ীন : ১০০১)।
শোকরানা সিজদা
নিয়ামত প্রাপ্তির পর বা বিপদণ্ডআপদ থেকে মুক্তি লাভের সময় মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পূর্ণাঙ্গ উপায় হলো কমপক্ষে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়া, তবে কেউ যদি এই সময় কৃতজ্ঞতার জন্য শুধু সিজদা করে, তাও জায়েজ আছে। নামাজ পড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শোকর আদায় রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সরাসরি তাঁর চাচাতো বোন হজরত উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন, গোসল করেন এবং আট রাকাত নামাজ আদায় করেন। একে সালাতুশ্-শোকর বলা হয়, যেহেতু এই নফল নামাজ চাশতের সময় আদায় করেছেন, তাই একে চাশতের নামাজও বলা হয়। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই নামাজ পড়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মক্কা বিজয়ের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের জন্য। তদ্রƒপ বদরের দিন আবু জাহেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) শোকরিয়া আদায়ের জন্য নামাজ পড়েছিলেন।
তবে শোকরিয়া আদায়ের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে শুধু সিজদা করার প্রমাণও রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে : ‘হজরত আবু বাকরা (রা.)-এর সূত্রে নবী (সা.) থেকে বর্ণিত। বস্তুত যখন তাঁর (নবী) কাছে কোনো সুখকর বিষয় আসত বা তাঁকে কোনো সুসংবাদ দেয়া হতো, তখন তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন।’ (আবু দাউদ : ২৭৭৪)।
বোখারি শরিফে এসেছে হজরত কা’ব ইবনে মালেক (রা.) যখন তাওবা কবুলের সুসংবাদ পেলেন, তখন মহান আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। (বোখারি : ৪৪১৮)।
তাই নিয়ামতপ্রাপ্ত হলে বা বিপদণ্ডআপদ সরে গেলে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের জন্য শুধু সিজদা করাও জায়েজ-বৈধ। আর পূর্ণাঙ্গ নামাজ আদায় করা হলো কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সর্বোচ্চ স্তর।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, এমন পরিস্থিতিতে শুধু সিজদা করার পরিবর্তে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়া উচিত, যাকে শোকরানা নামাজ বলে। মক্কা বিজয়ের সময় এবং বদর যুদ্ধে আবু জাহেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে যেমনটি করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।
ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন : নতুন নাজ-নেয়ামত ও ধন-সম্পদ হাসিল হলে, সন্তান-সন্ততি জন্ম হলে বা হারিয়ে যাওয়া বস্তু খুঁজে পেলে, বিপদণ্ডআপদ সরে গেলে ও অসুস্থ ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করলে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের জন্য শুধু সিজদা করা এমন ইবাদত যার জন্য তাকে সওয়াব দেয়া হবে, পুরস্কৃত করা হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৩৬)।
শোকরানা সিজদা আদায়ের পদ্ধতি
শুধু সিজদার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পদ্ধতি হলো, কিবলা অভিমুখে দাঁড়াবে, অতঃপর তেলাওয়াতে সিজদার মতো আল্লাহু আকবার তাকবির বলে সোজা সিজদায় চলে যাবে এবং সিজদার তাসবিহ পাঠ করবে, তিন/পাঁচবার। তারপর দ্বিতীয় তাকবির বলে সিজদা থেকে মাথা ওঠাবে। তবে ফরজ নামাজের পর বা মাকরুহ সময়ে শোকরানা সিজদা আদায় করা থেকে বিরত থাকবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৩৬)।
অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের অভিমত হচ্ছে, শোকরানা সিজদা যেহেতু নফল ইবাদত, তাই তেলাওয়াতে সিজদার মতো তার জন্যও তাকবিরে তাহরিমা ছাড়া কিবলামুখী হওয়া, সতর ঢেকে রাখা ও পবিত্রতাসহ নামাজের যাবতীয় শর্ত প্রযোজ্য। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৩৫)।
খেলাধুলায় বিজয়ী হওয়া কোনো নেয়ামত অর্জন নয়, সর্বোচ্চ এটাকে শর্তসাপেক্ষে মুবাহ বলা যায়। এই জন্য ফুটবল বা অন্যান্য যেকোনো খেলাধুলায় বিজয়ী হওয়ার পর শোকরানা সিজদা আদায়ের সুযোগ ইসলামি শরিয়তে নেই। এছাড়া তখন খেলোয়াড়দের সতর তথা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে না, পবিত্রতার ব্যাপারে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। সতর খোলা বা অপবিত্র অবস্থায় সিজদা করাকে অনেকেই হারাম বলেছেন। (বাদায়েউস্ সানায়ে : ১/১৮৬)।
আমাদের মনে রাখতে হবে, খেলাধুলা শুধু আনন্দণ্ডবিনোদনের জন্য নয় বরং বৃহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য, শারীরিক ও ধর্মীয় উন্নতি-সমৃদ্ধির জন্য। বর্তমানে যেসব খেলাধুলার প্রচলন রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেসব খেলাধুলা অস্তিত্বে আসবে, সবগুলোকে শারীরিক ও ধর্মীয় কল্যাণ-উপকারিতার মানদণ্ড দ্বারা বিচার করতে হবে। যে খেলায় অযথা সময়, অর্থ ও স্বাস্থ্য ক্ষয় হবে এবং নীতি-নৈতিকতার লঙ্ঘন হবে, ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তা হবে নাজায়েজ-অবৈধ। আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা থেকে বেঁচে থাকা একান্ত কর্তব্য।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা, বসুন্ধরা, ঢাকা