ঢাকা শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গুজব ও অপপ্রচার : ইসলামের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
গুজব ও অপপ্রচার : ইসলামের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ

তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ সহজ করেছে। এখন পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের চেনাজানা আপনজন বা অপরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান ও তথ্যের বিনিময় করতে পারে খুব সহজেই। প্রযুক্তির এই উন্নয়ন মানুষের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। গোটা মানবজাতিকে গতিশীল করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষকে বিভ্রান্তও করছে। মানুষ স্বার্থ হাসিলের জন্য সমাজে ভুল ও মিথ্যা কিংবা আংশিক মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমাজে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে এই গুজব ও মিথ্যার সয়লাব প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। গুজবের এই ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন কঠোর আইন, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা।

গুজব শব্দটি বাংলা, যার আরবি প্রতিশব্দ ইশায়াতুন। অর্থ রটনা বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, যার কোনো ভিত্তি নেই। জনসাধারণ সম্পর্কিত কোনো বিষয়, ঘটনা, তথ্য বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত অমূলক, বিকৃত বর্ণনা বা গল্পকে গুজব বলা হয়। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি, যার সত্যতা নিশ্চত বা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। গুজব অনেক ক্ষেত্রে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘অসংগত তথ্য’ বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়।

গুজব ছড়ানো ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুজব ছড়িয়ে যারা মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নত করে এবং সম্মানহানি করে, তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধানও রয়েছে ইসলামে। ইসলামের শিক্ষা হলো, মানুষ সর্বতোভাবেই তা পরিহার করবে। বরং প্রয়োজন ব্যতীত কোনো কথা সে বলবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে চুপ থাকে সে মুক্তি পায়।’ (তিরমিজি : ২৫০১)।

যারা প্রচারিত কোনো সংবাদ নিজের মত, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে হলে তা যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করে না। পাওয়ামাত্রই প্রচার শুরু করে। ইসলাম এই প্রবণতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তা বলে বেড়ায়।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯২)।

হাদিসবিশারদরা এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোনো কথা শুনেই প্রচারের প্রবণতা মানুষকে মিথ্যায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়। ফলে সে পৃথিবীতে লজ্জিত হয় এবং পরকালেও তার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান।

সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থ জড়িত থাকে। মিথ্যা সংবাদের প্রচার কিংবা গুজব মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধ্য করে এবং কখনও কখনও তা ব্যক্তি কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই সংবাদ প্রচারের আগে অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মোমিনরা! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজুরাত : ৬)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : ৩৬)।

যে নেতিবাচক সংবাদের সঙ্গে সমাজ, জাতি ও উম্মাহর স্বার্থের সম্পর্ক নেই- শুধু ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান থেকে হয়ে থাকে, তা প্রচার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, তা অপবাদের স্তরভুক্ত হবে। পবিত্র কোরআনে অপবাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। এমন নেতিবাচক সংবাদের যদি কোনো ভিত্তিও থেকে থাকে, তবে তা গিবত বা পরনিন্দা বিবেচিত হবে। শরিয়তে গিবতও জঘন্যতম অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের দোষচর্চা কোরো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা অপছন্দ করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

গুজব ছড়ানোর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। তাদের আতঙ্কিত করা। মানুষের ভেতর বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে কোরআনে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তারা তোমাদের সঙ্গে বের হতো, তবে শুধু বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি পেত। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তারা তোমাদের ভেতর ছোটাছুটি করত। তোমাদের ভেতর তাদের কথা শোনার (গুপ্তচোর) লোক রয়েছে। আল্লাহ অত্যাচারীদের সম্পর্কে অবগত আছেন।’ (সুরা তাওবা : ৪৭)।

সমাজে বা সামাজিক মাধ্যমে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম সমাজের উচিত তাতে আক্রান্ত না হওয়া। তার প্রসারে সহযোগিতা না করা। বরং যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা। পবিত্র কোরআনেও এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কাছে নিরাপত্তা বা ভয়ের কোনো সংবাদ পৌঁছে, তখন তারা তা প্রচার করে। যদি তারা তা (সংবাদটি) রাসুল বা তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তির দৃষ্টিগোচর করত, তবে তাদের (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অনুসন্ধানকারীরা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত, তবে সামান্যসংখ্যক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করত।’ (সুরা নিস : ৮৩)।

আলোচ্য আয়াত থেকে গুজব রটানো শয়তানের কাজ বলেই প্রমাণিত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসেও গুজবকে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে এবং তাদের মিথ্যা কথা শোনায়। অতঃপর লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ বলে, আমি এমন এক ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনেছি, যার চেহারা চিনি, কিন্তু নাম জানি না। ’ (সহিহ মুসলিম)।

আর কোনো বিষয়ে ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করাই হচ্ছে অপপ্রচার। আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার মহামারির আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে এটা প্রতিপক্ষকে দমনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। কোনো ব্যক্তি অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো দলকে জনসাধারণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে অপপ্রচারের বিকল্প নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কারও বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে তার সম্মানহানি করা জঘন্য পাপ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভুল করে কিংবা কোনো পাপ করে অতঃপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি অপবাদ আরোপ করে, সে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা নিসা : ১১২)।

বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কোনো কিছু পোস্ট করল আর তার সত্যতা যাচাই না করেই সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার শেয়ার আর লাখ লাখ লাইক হয়ে তা ভাইরালও হয়ে যায়। এর ফলে দেশে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা আমরা একবারের জন্যও চিন্তা করি না। বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ ও গুজব ছড়িয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা নষ্ট করা মারাত্মক অপরাধ আর এসব শয়তানের কাজ। যারা গুজব ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করতে হবে। আর মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, সমাজে কোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তার প্রচার ও প্রসার থেকে বিরত থাকা। বাস্তবতা অনুসন্ধান করে নিজে সতর্ক হওয়া এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তা অবগত করা। সর্বোপরি নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করা।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলাম লেখক প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত