ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শরতের প্রকৃতি ও পরিবেশ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
শরতের প্রকৃতি ও পরিবেশ

ঋতুরানি শরৎকালে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। সবখানে শুধু কাশফুলের শুভ্রতা আর সাদা মেঘের ভেলা। চারিদিকে নতুন সবুজ আর ফুলের মেলা। নদীর ধার আর উলোবনে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে পাঁজা পাঁজা তুলোর মতো মেঘ উড়ে যায়। শরৎকালের প্রকৃতিতে যেন রূপের মেলা। রূপের যেন নেই কোনো তার শেষ। ঋতুর রানি শরৎকাল। বর্ষার ঘন বাদল বৃষ্টি শেষ হলে আগমন ঘটে শরতের। শ্রাবণ শেষে অবিরত বৃষ্টির বিরাম ঘটলেই প্রকৃতি নতুন রূপে সাজে। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরান রং মেশানো শেফালি, টগর আর শিউলি ফুল। গাছে গাছে নানা রঙের ফুল আর বিলে শাপলার সমারোহ। সকালে শিশিরভেজা ফসলের মাঠে পাকা ধানের ডগায় সোনালি রোদ গলে গলে পড়ছে। ধানখেতের পাতায় শিশিরবিন্দু জানান দিচ্ছে শীত আসছে। গাছপালা হয়ে উঠছে সতেজ ও সুন্দর। শরৎকালের প্রকৃতিতে এ যেন এক অনন্য রূপ।

শরতের বাহারি রূপ যেমন : আকাশের দীপ্তিমান নীল রঙের আভা। ঘন মেঘের নীলিমা স্পর্শ করে মালার মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় নানা প্রজাতির পাখি। শরৎ নিয়ে আসে অন্যরকম এক মধুরতা। সূর্যের নরম আলোয় সবুজ প্রকৃতি হয় মনোমুগ্ধকর। গাছপালা হয়ে ওঠে সতেজ ও সুন্দর। মনে হয় চারিদিকে সবুজের সমারোহ। ধানক্ষেত হয়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো সবুজ প্রান্তর। নদীর তীরে কাশবনে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। ভোরবেলা শিউলি তলায় হালকা শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছানো থাকে সুমধুর ঘ্রাণ মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ার মধুর গুঞ্জন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ভাদ্র ও আশ্বিন দুই মাস মিলে শরৎকাল। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু। শরৎকে ইংরেজিতে অটাম বলা হলেও উত্তর আমেরিকায় একে ফল হিসেবে ডাকা হয়। পৃথিবীর ৪টি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে আগমন করে। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি আসে এবং আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে। মেঠোপথের ভোরে হালকা কুয়াশা। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মৃদু হাওয়া। এরপর কাঠফাটা রোদ। কখনো আবার পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিও এদিকে আছে তো ওদিকে নেই। বাইরে গেলে কখনো সিক্ত, কখনো বৃষ্টিস্নাত। এই তো শরতের রূপ।

ভেসে চলে সাদা মেঘের খেয়া : শরৎ বাংলার ঋতু পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু। শরতের জোছনার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। যে ঋতুতে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ধরা দেয় প্রকৃতি, সেই শরতের রূপের তুলনা নেই। শিউলিঝরা সকাল, দুর্বাঘাসে শিশিরের ফোঁটা, নদী তীর বা বনের প্রান্তে কাশফুলের সাদা এলোকেশের দোলা, আকাশের নরম নীল ছুঁয়ে ভাসা শুভ্র মেঘের দল, নৌকার পালে বিলাসী হাওয়া বাংলার শরতে প্রকৃতির এমনই মনভোলানো দান। এ সময় মেঘমুক্ত আকাশে শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে সাদা মেঘের খেয়া। ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলা পাখণ্ডপাখালির ঝাঁক, বাঁশবনে ডাহুকের ডাকাডাকি, বিলঝিলের ডুবো ডুবো জলে জড়িয়ে থাকা শালুক পাতা, আঁধারের বুক চিরে জোনাকির রুপালি সেলাই, ঘোরলাগা চাঁদের আলো, কী নেই এই ঋতুর কাছে! শরতের এক আনন্দময় ঘ্রাণ আছে। হয়তো এ জন্য বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতিতে শরৎ আসে নববধূর মতো।

শরতের দুই মাসে দুই রকম মেজাজ : গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের পর এই ঋতু জনজীবনে আসে ভিন্ন চেহারায়, স্বস্তি নিয়ে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও মনোরম। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে মাঠে তখন কচি ধানের হেলেদুলে কাটানো কৈশোর। এমন সবুজের সমারোহে কবিমন গেয়ে ওঠে- আজি ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা; নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।

শরতের রূপটাই এমন, যে রূপে সাধারণের মনটাও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। অবসাদগ্রস্ত মনটাতেও নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। তবে শরতের দুই মাসের আবার দু’রকম মেজাজ। কখনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। কোথাও কোথাও এ মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। আবার এই ভাদ্রতেও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। প্রবীণরা বলেন ‘পচা ভাদ্দের’। তবে আশ্বিনে রাত তাড়াতাড়ি আসে। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাদ্র থেকে আশ্বিনের বন্দনাই বেশি করেছেন। পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের নীলাকাশ দেখে কবির মন আপনা-আপনি গেয়ে ওঠে, অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু, দেখি নাই এমন তরুণী বাওয়া।

শরৎ যেন নির্মলতার ঋতু : প্রকৃতির রানি শরৎ ফুলেরও ঋতু। অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। এ ঋতুর রয়েছে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুঘ্রাণে এ সময় ফোটে গগন শিরীষ, ছাতিম, বকফুল, শেফালি, শিউলি, কলিয়েন্ড্রা, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতী ইত্যাদি। যারা শরতের সঙ্গী হয়ে মন ভরায় সৌন্দর্য পিপাসুদের। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়- এসো শারদ প্রাতের পথিক! এসো শিউলি বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে। শরতের অন্যতম আকর্ষণ কাশফুল। নদী তীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। শরৎকালে প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কাশফুল। তাইতো কাশবনে ছুটে বেড়ায় দর্শনার্থীরা। সৌন্দর্য উপভোগে মেতে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমীরা। গগনে শুভ্র মেঘের ভেলা আর নদীতটে সাদা কাশফুল, মালার মতো আকাশগঙ্গায় উড়ে চলা পাখির ঝাঁক, সকালবেলা হালকা শিশিরভেজা সবুজ ঘাস আর শিউলিতলায় সুঘ্রাণ মাখানো শিউলিফুল, নরম রোদের ঝলমলে আলো; সব মিলিয়ে শরৎ যেন নির্মলতার ঋতু। শরতের রাতে দেখা মেলে জোছনার মোহনীয় রূপ। সাহিত্যের অনেকাংশ জুড়ে আছে শরৎকাল; যার সবটুকুই উৎসব আর আনন্দের। এ সময় বুড়োবুড়িরা ছোটদের কিচ্ছা শোনায় জোছনা রাতে।

উৎসবের ঋতু শরৎ : হেমন্তকে বলা হয় ফসলের ঋতু; আর শরৎ হলো ফসল সম্ভাবনার। কৃষিনির্ভর বাংলার বুকে প্রাপ্তির আশা জাগিয়ে তোলে শরৎ। কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনেন। কারণ, এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। দুর্বাঘাস ভিজে যায় হালকা শিশিরে। চারদিক আমন ধানের সবুজ চারার ওপর ঢেউ খেলে যায় উদাসী হাওয়া। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকরা আসন্ন নবান্নের আশায়। বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে সাদা ও লাল শাপলা। এ সময় ফল হিসেবে পাওয়া যায় আমলকি, জলপাই, জগডুমুর, তাল, অরবরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি। আকাশ থেকে কল্পলোকের পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। শরতের দিনরাতের মনকাড়া সৌন্দর্য বাংলার মানুষকে মোহিত করে। এ কারণে বলা যায়, শরৎ বাংলার ঋতুরূপের রাজকুমারী। তবে শরৎ যেন দিন দিন হয়ে উঠছে বইয়ের পাতার বাসিন্দা। নাগরিক জীবন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ছুটছে। যখন রুটি-রুজির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত অনেকে, তখন শরতের অপরূপ বিভা দেখার ফুরসত কোথায়! তাছাড়া যে কাশফুল শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে, দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সেই কাশফুলের বন। গড়ে উঠছে গগনচুম্বী ইমারত। শরতের সৌন্দর্যের উৎসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়নে। এসব টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত