ইসলামে পথ ও পথিকের দায়িত্ব এবং অধিকার

মুফতি আতিকুল্লাহ বিন আসাদ

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে পথেঘাটে চলাচল করতে হয়। মানুষের এই চলার পথ নিরাপদ, নিষ্কণ্টক ও শান্তিপূর্ণ হওয়া জরুরি। ইসলামে পথিকের জন্য পথ চলাচলের কিছু বিধি-বিধান দেওয়া হয়েছে। এগুলো মেনে চললে পার্থিব জীবনে যেমন বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তেমনি পরকালেও অশেষ সওয়াব লাভ করা যাবে। হাঁটাচলার মধ্যে একজন মুসলমানকে মধ্যম গতি অবলম্বন করা কর্তব্য। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না। তুমি তো পদভারে ভূমিকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩৭)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পথে বসা থেকে বিরত থাক। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য পথে বসার বিকল্প নেই। রাসুল (সা.) বললেন, যদি তোমাদের একান্ত বসতেই হয়, তাহলে পথের হক আদায় কর। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! পথের হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টিকে অবনত রাখা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, সালামের জবাব দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা।’ (বোখারি : ৬২২৯)। হাদিসের অন্যান্য বর্ণনায় আরও কিছু বিষয় এসেছে। যেমন পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, মজলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা, বোঝা বহনকারীকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি।

পথচলার সময় একটি হক হচ্ছে, দৃষ্টি অবনত রাখা। যে ব্যক্তি রাস্তায় চলবে বা দাঁড়াবে কিংবা বসবে সে দৃষ্টি নিচু রাখবে। কারণ রাস্তায় বেগানা নারী ও অবৈধ দৃশ্য নজরে পড়তে পারে। এসব থকে দৃষ্টি হেফাজত করলে চোখের গোনাহ থেকে বাঁচা যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মোমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত।’ (সুরা নূর : ৩০)।

পথে দাঁড়ানো বা বসা ব্যক্তির খেয়াল রাখা উচিত, যেন তার দ্বারা কোনো চলাচলকারীর সামান্য কষ্টও না হয়। রাস্তায় কাউকে পাশ না দেওয়া, অন্যের যানবাহন আটকে রেখে নিজের পথ সুগম করা, অহেতুক রাস্তা বন্ধ করা, ফলের খোসা, উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা, পানের পিক ফেলা, দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ফেলে রাখা সবই কষ্ট দেওয়ার নানা উপায়। রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক জিনিস দেখলে তা সরিয়ে দেওয়া ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে, সর্বোত্তম শাখা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা, সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া, আর লজ্জা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা।’ (মুসলিম : ৩৫)।

পথ চলতে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যায়, যারা পথ চেনে না। এমন পথিকদের পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং অন্ধ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের রাস্তা পারাপারে সাহযোগিতা করা মহৎ নেক কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘পথ না চেনা ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দেওয়া তোমার জন্য একটি সদকা।’ (তিরমিজি : ১৯৫৬)। আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো দুগ্ধবতী বকরি দান করে অথবা কাউকে ঋণস্বরূপ অর্থ প্রদান করে কিংবা কাউকে পথ দেখিয়ে দেয়, সে একটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভ করবে।’ (তিরমিজি : ১৯৫৭)।

পথিকের অন্যতম দায়িত্ব হলো সালামের জবাব দেওয়া। একজন মুসলমান যখন আরেকজন মুসলমানকে সালাম দেয়, তখন সেই সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। এই উত্তর সালাম প্রদানকারীর অধিকার। সালামের সাধারণ নিয়ম হলো, আরোহী ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তিকে আর হেঁটে চলা ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে সালাম দেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে ও অল্প মানুষ বেশি মানুষকে সালাম দেবে।’ (বোখারি : ৬২৩২)।

পথে যদি কোনো অন্যায় কাজ চোখে পড়ে তখন সাধ্যমতো বাধা দিতে হবে এবং সৎকাজের আদেশ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্যরে প্রতি লক্ষ রাখবে এবং নিজের সামর্থ্যটুকু যথাযথ ব্যবহারের প্রতিও যতœবান হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় কাজ দেখে তখন যেন সে নিজ হাতে তা প্রতিহত করে। যদি তা তার পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে মুখে বাধা দেবে। যদি তাও না পারে তাহলে অন্তরে তা ঘৃণা করবে। আর এটিই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।’ (মুসলিম : ৪৯)।

লেখক : খতিব, রোশাদিয়া শাহি জামে মসজিদ, উত্তরা, ঢাকা