ঢাকা বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীতের সকাল শহর-গাঁয়ে

হাবীবুল্লাহ সিরাজ
শীতের সকাল শহর-গাঁয়ে

শীতের প্রকৃত রূপ-রস-ঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকে সবুজের ভরপুর গ্রামে। গ্রামাঞ্চলে শীত সকালের নরম রোদ মানুষের জীবনে এনে দেয় প্রশান্তির অন্যরকম স্বাদ। উঠোনে গোল হয়ে বসে গা সেঁকা, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক কিংবা পুরোনো দিনের গল্প, বয়সীদের গালগল্পের আসর, কিশোর-কিশোরীদের খেলা গোলযোগ- শীতের অবিচ্ছেদ্য আনন্দ। কেউ আবার শীতের রোদে বসে বই পড়ে, কেউ আলস্যভরা মুহূর্ত উপভোগ করে নিস্তব্ধতার সঙ্গে কথোপকথন করে। গ্রামের এ সহজ-সরল সকালে শীত যেন আরও মানবিক, আরও ঘনিষ্ঠ ও প্রেমময়। সরিষার হলুদ মাঠ, মৌমাছির সুর, পাখির কলরব আর নরম রোদের উষ্ণতা- সব মিলিয়ে শীত হয়ে ওঠে অনুভূতি, স্মৃতি আর সৌন্দর্যে ভরা অভিজ্ঞতায়।

জীবনযাত্রায় শীত : শীতের কঠিন দিনগুলোতে কখনও কখনও শৈত্যপ্রবাহ নেমে আসে, আর তাপমাত্রা দ্রুত কমে গিয়ে পরিবেশে জমাট শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়টি বিশেষ করে গ্রাম-শহরের নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাদের অনেকেই মোটা জামা-কাপড়ের অভাবে কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করে দিন কাটায়। তাই সন্ধ্যা নামলেই তারা ছোটখাটো আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করার চেষ্টা করে। এটিও শীতের একটি ক্লান্তিকর অধ্যায়। তবু আবহমান কাল থেকে বাংলার মানুষের এ আয়োজন স্বতঃস্ফূর্ত। ভোর বা গভীর রাতে রাস্তার ধারে, চায়ের দোকানের সামনে কিংবা বাড়ির উঠোনে জ্বলা আগুনের চারদিকে মানুষের ভিড় জমে। কেউ হাত পোহায়, কেউ আগুনের তাপে পা সেঁকে নেয়, আর কেউ বা চুপচাপ আগুনের নাচ দেখে নিজের মন ও শরীরকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে। এ আগুনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা মানুষগুলোর মধ্যে যেন এক ধরনের নীরব বন্ধন তৈরি হয়। শীতের তীব্রতায় সবাই সমানভাবে কাঁপে, আর উষ্ণতার ভাগাভাগিতে যেন সবার হৃদয়ে সহমর্মিতা আরও গভীর হয়ে ওঠে। এ মুহূর্তগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির কঠিন বাস্তবতার মাঝেও মানুষের মানবিকতা, সহানুভূতি ও একাত্মতা কখনোই হারিয়ে যায় না।

শীত ও সূর্য : শীতের ভোর যেন এক রহস্যময় আবরণে ঢাকা। কখনও এত ঘনকুয়াশা নামে যে, সামনে হাত বাড়ালেও নিজ হাতটাই অস্পষ্ট মনে হয়। পথঘাট, গাছপালা, ঘরবাড়ি, খেতখামার, ফসলি জমি, নদীনালা খালবিল- সবকিছু কুয়াশার সাদা আবরণে হারিয়ে যায়। দূর থেকে মনে হয়, যেন কুয়াশার অসীম পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে; যার ভেতর দিয়ে মানুষ আর যানবাহন গুটিগুটি পায়ে পথ খুঁজে এগোতে থাকে। গাড়িগুলো তখন হেডলাইট জ্বালিয়ে চলে, আলো কেটে এগোয় ধীর গতিতে- যেন নিশ্চিদ্র সাদা পর্দায় পথ আঁকা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। ধীরে ধীরে যখন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঁকি দেয়, তখন কুয়াশার স্তরগুলো আলোর উষ্ণতায় গলে যেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই সেই কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবী আশ্চর্যভাবে বদলে যায়। সূর্যের কোমল আলো গাছের পাতায় ঝুলে থাকা শিশিরফোঁটায় পড়ে ঝিলমিল করে। প্রকৃতি আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। রঙবেরঙের শীতবস্ত্রে মোড়া মানুষ তখন নিজেদের কাজের উদ্দেশে পথ ধরতে থাকে। কেউ অফিসে যায়, কেউ বাজারে, কেউ বা মাঠে। শিশুদের হাতে থাকে উলের দস্তানা, বৃদ্ধদের কাঁধে পুরু শাল। সকালের সেই পুনর্জাগরণ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষেরও এক নতুন সূচনা; কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে আলোয় ভরা নতুন দিনকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি।

শীত সকালের চা পান : গ্রাম কিংবা শহর মফস্বল শীতের পানীয় মানেই চা। কুয়াশাভেজা সকালেই চায়ের দোকানে জমজমাট ভিড়, যেন ছোট্ট দোকানটাই হয়ে ওঠে গ্রামের মিলনমেলা। কাঁপুনি ধরা হাওয়ার মাঝেও সবাই গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জড়ো হয়। শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ- কেউই বাদ থাকে না। ধোঁয়া ওঠা কাপের গাঢ় সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যেন শীতের তীব্রতাকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে দেয়। শিশু-কিশোরদের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুষ্টুমি করা যেন এ ঋতুর একটি চিরচেনা হাসির দৃশ্য। গরম চা খেতে খেতে তাদের মুখ দিয়ে ছোট্ট ধোঁয়া বের হয়, আর তারা মজা করে বলে- ‘দেখ, বিড়ি খাচ্ছি!’ এ সাধারণ কোলাহল, মানুষের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া, গল্পগুজব আর হাসির শব্দ- সব মিলিয়ে শীতের সকালকে দেয় এক অনন্য প্রাণ, এক মধুর অনুভূতি; যা শুধু শীতেই পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। শীতের পরে এগুলো হয় জীবনস্মৃতির গল্প।

পিঠাপুলি আর গ্রামবাংলার মমতা : শীতের আগমনী বার্তা যেন পিঠাপুলির ঘ্রাণেই প্রথম ধরা দেয়। শীত না এলে পিঠাণ্ডপুলির আসর যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভাপা, পাটি, চিতই- নানা স্বাদের পিঠার ধোঁয়ামাখা সুবাসে ঘর-বাড়ি ভরে ওঠে বিশেষ মায়ায়। কুসুম গরম ভাপার পিঠা থেকে বের হওয়া ধোঁয়া যেন শীতের সকালের কুয়াশার সঙ্গে ভালোবাসা বিতরণ করে। গ্রামবাংলার নারীরা আতপ চাল, গুড় আর নারকেল দিয়ে পিঠা বানাতে বসলে সেখানে তৈরি হয় উষ্ণতা, আন্তরিকতা, গালগল্প, স্মৃতিকথন আর মমতার অমূল্য দৃশ্য। কেউ চাল বাটে, কেউ পিঠা গড়ে, কেউ ভাপরে রাখে; এ সামষ্টিক কাজের ভেতর লুকিয়ে থাকে পারিবারিক বন্ধন ও গ্রাম্যজীবনের সহজ-সরল সৌন্দর্য। শীতের এ ঐতিহ্য শুধু একটি খাবারের নাম নয়; এটি স্মৃতির, ভালোবাসার আর পারস্পরিকতার এক কোমল প্রতীক। শিশুরা তখন সকালের মিষ্টি রোদে বসে চিড়া-মুড়ি-খেজুর গুড় খায়, আর সেই সঙ্গে রোদ পোহানোর আরামও উপভোগ করে। হাসিখুশি মুখ আর মিষ্টির স্বাদ মিলেমিশে গ্রামীণ শীতের সকালকে করে তোলে আরও উষ্ণ, আরও মধুর। শীত একা আসে না, আসে পিঠার মিছিল নিয়ে।

আগুন পোহানোর স্মৃতি-শৈশব : শীতের বিকেল নামতেই গ্রাম যেন আলাদা রূপ নেয়। শিশু-কিশোরদের ছোট ছোট দল মাঠ-ঘাট থেকে শুকনো খড়কুটো, ভাঙা ডাল আর পাতা জড়ো করে। তারপর এককোণে সবাই মিলে আগুন ধরায়। আগুন লাগতেই লালচে শিখা নাচতে নাচতে উঁচু হয়ে ওঠে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে উষ্ণতার অদ্ভুত মায়া, মেলবন্ধন আর আনন্দ হৈ-হুল্লোড়। আগুনের তাপে হাত-পা সেঁকে নিতে নিতে তারা গল্প করে, ঠাট্টা করে, কারো কারো মুখে আবার ছোট্ট গানের সুরও ভেসে ওঠে। সেই মুহূর্তগুলোতে যেন শীতও কোমল হয়ে যায়- চারদিকে কেবল হাসি আর আনন্দের আলো। আগুনের শিখা একটু একটু করে ছোট হয়ে আসে, অঙ্গারের লাল আভা নিভে এলে সবাই দল বেঁধে বাড়ির পথে হাঁটে। সেই ফেরার পথেও থাকে ঝগড়া-হাসি-মজা-শৈশবের অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি।

শীত আর কৃষক : শীত এলেই গ্রামবাংলার মাঠ যেন নতুন সুরে জেগে ওঠে। চারদিকে সোনালি ধানের ঢেউ, হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া প্রভাত। এ যেন কৃষকের জীবনচিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। ধান পাকার মৌসুমে মাঠে ব্যস্ততা থাকে চরমে। কাস্তের ঝনঝন শব্দে ভোর ভেঙে যায়। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে গোলায় ওঠে সোনালি ফসলের হাসি। তখন কৃষকের মন ভরে, চোখ ভরে, বুক ভরে, ঝড়ে পরে মাঠের ক্লান্ত অবসাদ। ধান ঘরে তুলতেই কৃষক আবার ছুটে যায় বোরো আবাদে। কনকনে ঠান্ডা, কুয়াশায় ভেজা সকাল- কিছুই তাদের থামাতে পারে না। জমিতে পানি তোলা, চারা রোপণ, সার দেওয়া- সব কাজই চলে নিরলসভাবে। শীতের প্রতিটি দিন যেন কৃষকের ঘামে লেখা একটি নতুন গল্প। এ গল্পগুলোই আমাদের ভালো থাকতে ভাত উৎপান করে। প্রকৃতিও যেন কৃষকের এ পরিশ্রমকে শ্রদ্ধা জানায়। কুয়াশার আড়াল থেকে সূর্য ওঠে ধীর পায়ে। তার আলোয় ঝলমল করে ওঠে সবুজ চারা ও সোনালি জমিন। কৃষকের শ্রম আর শীতের নীরব প্রকৃতি মিলেই সৃষ্টি করে বাংলার কৃষি-সংস্কৃতির সৌন্দর্য।

গ্রাম্য মকতবের সেই শীত : শীতের কুয়াশা জমে থাকে ঘাসের ডগায়, বাতাসে থাকে স্নিগ্ধ শীতলতা। তবু গ্রাম্য মকতবের সকাল থেমে থাকে না। কায়দা, সেপারা বা আমপারা বুকে চেপে দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা ছুটে যায় মকতবের পথে। ভোরের নরম আলোয় তাদের ছোট ছোট পায়ের শব্দে গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শৈত্যপ্রবাহের কনকনে হাওয়া মুখে লাগলেও তাদের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে না। কেউ গলায় মাফলার পেঁচিয়ে এসেছে, কেউ আবার মায়ের জাল সোয়েটারের উষ্ণতায় গুটিসুটি মেরে হাঁটে। তবু সবার চোখে একই রকম উচ্ছ্বাস। মকতবের আঙিনায় পৌঁছালে দেখা যায়, চারদিকে শিশিরমাখা মাটির গন্ধ আর তাদের ঠোঁটের কোণে জমে থাকা শ্বাসের ধোঁয়া। মাদুরে বসে ছোট ছোট হাতের স্পর্শে কোরআনের হরফ যেন আরও পবিত্র হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে শিক্ষকের শাসন সেই উষ্ণতায় আরও তেজ বাড়ায়।

শীত ইবাদতের বসন্তকাল : শীতকে বলা হয় ইবাদতের বসন্তকাল। কারণ, এ ঋতুতে আল্লাহর ইবাদত মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আরও সহজ, আরও সৌন্দর্যময়। রাতগুলো দীর্ঘ হয়, ভোরের স্নিগ্ধ আলো ধীরে ধীরে ফোটে। ফলে তাহাজ্জুদ, কিয়ামুল্লাইল কিংবা দোয়া-ইস্তিগফারের মতো নফল ইবাদত করার জন্য সময়ও অনেক বেশি মেলে। ঠান্ডায় যখন চারপাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে, তখন মোমিনের হৃদয় জেগে ওঠে আল্লাহর স্মরণে ও প্রেমে। ইবাদতের দীর্ঘ সময়ে শরীরে ক্লান্তি আসে না। রোজা রাখার ক্ষেত্রেও শীত এক অপূর্ব দয়া। দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায় রোজা পালন করা সহজ হয়, পিপাসা কম লাগে, আর ইফতারের আগপর্যন্ত ধৈর্য ধরে রাখা যেন আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দেয়। সেজন্যই সালফে সালেহিন বলেন, ‘শীত হলো মোমিনের বসন্তকাল।’ শীতের কনকনে বাতাস যেখানে প্রকৃতিকে নির্জীব করে, সেখানে আল্লাহর ইবাদত মানুষের অন্তরকে নতুন করে প্রাণ দেয়। কুয়াশা ভেদ করে যখন ফজরের আজান ভেসে আসে, মনে হয়- মানুষকে আবার নতুন করে ডাকছে তার রব।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত