প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
কাগজের ফুল আমার বেশ পছন্দের। ছেলেবেলায় কাগজ পেলেই কেচি নিয়ে বসে যেতাম। কাগজ কেটে কেটে একাকার করতাম গোটা শ্রেণিকক্ষ। ক্যাচক্যাচ শব্দে কান ভারী হয়ে উঠত সবার। আশপাশের পাঠবন্ধুরা ভ্রুকুটি করত খুব। কিচ্ছুটি বলতে গিয়েও আমায় বলতে পারত না কেন যেন। দেখতে সবার ছোট ছিলাম, বয়সেও। কারণ এটা কিনা, কে জানে! পৃথিবীর অনেক কিছুই জানা নেই আমার। অজানা থাকা বেশ ভালো গুণ; গুণীজন বলে গেছেন কথাটি। তেমন বিপাকে পড়তে হয় না হুটহাট। সরল বনার কাঁধে চেপে পার পাওয়া যায় সহজেই। নিজেকে একটুখানি বোকার চাদরে জড়ালামই না হয়, তাতে কি!
আহারে, কাগজের সেইসব ফুল! সেইসব গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলেল দিনরাত্রি আমার! মনে পড়তেই চোখের কোণে বিরহী জল জমে। বুকের ভেতর অজানা এক মায়াভরা বেদনা কোঁকিয়ে ওঠে। আহারে, সেইসব ফুল দেখলে উস্তাদজি আমার রেগেমেগে আগুন হতেন- ‘কীরে! তোর পড়া নেই?’ কিতাবের পাতায় মুখ লুকিয়ে রাখতাম অমনি। বনে যেতাম একদম অবুঝ বালক। কিন্তু চুপটি করে বসে বসে ভাবতাম কাগজের হেরফের নিয়ে। নতুন কিছু বানাতে অধীর আগ্রহে সময় গড়াতাম।
তদারকির তাগাদা পড়তেই উস্তাদজি যেই অন্য শ্রেণিকক্ষে যেতেন, অমনি সুপ্ত শিল্পবুদ্ধি ফের মাথায় উঁকি দিত। বেঞ্চির তলে লুকিয়ে রাখা গুচ্ছ কাগজ একে একে টেনে বের করতাম। একেকটা করে কেটে ফুল বানাতাম। তাকের নিচে আড়াল করে বই চাপা দিয়ে রাখতাম সেসব। এখনও কাগজে ঠাসা শিক্ষকতার কক্ষ আমার; কিন্তু সেইসব রঙিন দিনের আলোয় ভরা কাগুজে জীবন আর নেই। এখনও বেঞ্চিতে বসে পড়ি, পড়াই; কিন্তু ছাত্রত্বের সেইসব হৈ-হুল্লোড়, দস্যিপনা আর নেই। আহারে জীবন আমার! কত সহজে, কত অল্পতেই বদলে গেল ভিন্ন এক জীবনছবিতে!
কাগজ কেটে বানাতাম সূর্যমুখী, রক্তজবা, দেখতে সুন্দর নাম না জানা হরেক রকম ফুল। কক্ষের সহপাঠী বন্ধুরা বেশ হাসাহাসি করত আমার সেসব পাগলামো দেখে। ওদের উপেক্ষা করতাম বরাবরই। মন যা বলত, তা-ই শুনতাম, করতাম প্রায়ই। চেনাজানা পৃথিবীতে নিজের মতো করে নিজের ভেতর একটা পৃথিবী গড়েছিলাম। যেখানে একলা একা বাস করতাম দিবানিশি। দোতলার ছাদে চাঁদটাকে সঙ্গী করে হাঁটতাম শূন্য পায়ে। নিভু নিভু তারকারাজির খেলা দেখতাম অনেকটা রাত গড়িয়ে। তবু যেন মন ভরত না। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাই খাতায় আঁকতাম থোকায় থোকায় জ্বলে ওঠা তারকার অবয়ব। সেসব কথাগল্প আজও জ্বলজ্বল করে আমার হারানো দিনের রোজনামার পাতায় পাতায়।
স্পষ্ট মনে আছে, ‘মুনশি’ হয়ে ওঠা হয়নি তখনও; মালিবাগ জামিয়ায় কাফিয়া জামাতে পড়ি। বেশকিছু ছেলে আমায় বড্ডো ভালোবাসত, হৃদয় থেকেই। হুসাইন, ওমরবাবু, হুজাইফা, ইসমাইল, আবদুল্লাহ মাসুম- এদের ভুলতে পারি না সেসব কারণেই। আরও কতজন বিস্মৃত হয়েছে স্মৃতির খোলা ঝাঁপি থেকে; মুচ্ছে যাচ্ছে রোজ রোজ দিন বদলের তালে তালে, সে খবরই বা ক’জনের আছে! কিন্তু এর বেশি বহুজন হিংসা করত আমায়, যাচ্ছেতাই মন্তব্য জুড়ে দিত আমার নামের শূন্যঘরে। সবার অগোচরে তাই এমনটা করা ছিল আমার রোজকার জীবনগল্প।
আজ একটুখানি বড়বেলায়, ঘুরে দাঁড়ানোর সময়প্রহরে আবার সেই কচিবেলার দিনগুলোয় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। কেন যেন আবার সাজতে ইচ্ছে হয় নিজেকে শৈশবের সেই রঙিন দিনে। আহারে, কত কী যে করেছি! সেসব মনে পড়তেই নিজেকে আবার গুলুমুলু বাবু বাবু লাগে। একটুখানি বড় হওয়ার সাধটুকু নিমিষেই হেরফের হয়ে যায়। কী নিদারুণই না ছিল সোনাঝরা আমার সেইসব ফেলে আসা দিনময়!
শৈশব থেকে কৌশোর পেরোল। এলো ভরা উচ্ছ্বল তারুণ্য আমার জীবনমহুয়ায়। যৌবনের বসন্তও হয়তো বা ধরা দেবে একদিন। হারাব এভাবেই হয়তো সব চেনাজানা জীবনকাহন। ভাবনার এমন মুহূর্তে কাছের একজন ছাত্র আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেইসব মখমল দিনে। ক’দিন ধরে অনেক কষ্ট করল দরসের ফাঁকে ফাঁকে। আমার সারাটা কক্ষ সাজাল কাগজ কেটে কেটে, শৈশবমুখর সেই ফুলে ভরা জীবনমিছিলে।
শৈশব থেকে বহু বেলা পেরিয়েছি, চেনা সব অচেনা হতে শুরু করেছে। ওর করা কাগজের এই ফুলগুলোর নাম তাই আর মনে করতে পারছি না ঠিক করে। ভালোবেসে, হৃদয়ের এক রাশ ফুলেল প্রার্থনায় জড়িয়ে রাখলাম ওকে এবং আমার সব শিক্ষার্থী, বন্ধু, শৈশবের দিনরাত্রিকে। ভালোবাসি শৈশবের এ কাগুজে ফুল, পৃথিবী ও মাটি-মানুষ, আদরে উতলে ওঠা দিনময়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক