শীত ইবাদতের বসন্তকাল

হাবীবুল্লাহ সিরাজ

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শীতের আগমনে পৃথিবী নতুন এক আবহে ভরে ওঠে। ভোরের মাঠে জমে থাকা শিশিরবিন্দু রোদ পেয়ে যখন হীরের মতো ঝলমল করে, তখন মনে হয়- প্রকৃতি যেন নীরবে সেজেছে কুহেলিকাণ্ডস্বর্ণে। ঘাসের ডগায়, পাতার কোণে, কচি ফুলের গায়ে জমা স্ফটিক স্বচ্ছ শিশির শীতের প্রথম কবিতা লেখে। শীতের সকালের কুয়াশা গ্রামকে মুড়িয়ে ফেলে ধূসর শুভ্র চাদরে। বাগ-বাগিচা ভরে ওঠে নতুন ফুলে, নতুন ফলে। কোথাও শিমের লতা বাতাসে দোল খায়, কোথাও সরিষার মাঠ সোনালি ¯্রােতে ঝলকে ওঠে। সবজিক্ষেতে বেগুন, মুলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, মিষ্টি কুমড়ার সারি সারি সমারোহ- সব মিলিয়ে শীত যেন কৃষকের প্রাণের ঋতু। জমি উর্বর হয়, ফসল পাকে, প্রকৃতি হয়ে ওঠে অফুরন্ত দানের ভাণ্ডার।

ইবাদতের বসন্তকাল শীত : শীতকাল মোমিনের জীবনে নিয়ে আসে এক বিশেষ আত্মিক আবহ। এটি এমন এক ঋতু, যখন কিছু ইবাদত হয়ে ওঠে সহজ, স্বস্তিকর। মনে হয় আল্লাহ নিজেই যেন তাঁর বান্দাদের জন্য ইবাদতের পথ নরম ও সহজ করে দিয়েছেন। দিবস ছোট হওয়ায় রোজা রাখা সহজ হয়। কোলাহলমুক্ত দীর্ঘ রাত জেগে ওঠা যায় তাহাজ্জুদের আহ্বানে। কনকনে শীতের অজুও হয়ে ওঠে নেক আমলের ভারী সোপান। কারণ, প্রতিটি কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহ দান করেন মাগফিরাত ও অফুরন্ত সওয়াব। কেউ কম্বল দেয়, কেউ গরম কাপড় বিলায়; শীত তখন দান-সদকারও নিভৃত ঋতু হয়। যেন পুরো ঋতুটিই মনে করিয়ে দেয়, পৃথিবী শুধু ভোগের নয়, সৎকর্মে পূর্ণ করার সুযোগ। এভাবে শীত আমাদের কাছে দ্বিগুণ সৌন্দর্য নিয়ে আসে প্রকৃতির অপার রূপ এবং ঈমানের প্রশান্ত সুযোগ নিয়ে।

আল্লাহর পরিচয় লাভের সুযোগ : শীত গভীর চিন্তার, আত্মসমালোচনার এবং আল্লাহর কুদরত দর্শনের অনন্য মৌসুম। আসমান-জমিন ও এ দুয়ের মাঝে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শন আমাদের প্রতিনিয়ত ডাকে- দেখ, ভাবো, চিন্তা কর; এ সমস্ত সৃষ্টি কেবলই কাকতালীয় নয়! শীত সেই ডাককে আরও তীব্র, আরও স্পষ্ট করে তোলে। রাত যখন দীর্ঘ হয়, কুয়াশায় ঢাকা ভোর যখন ধীরে ধীরে আলোয় স্নান করে, তখন মনে হয় এ পরিবর্তন কে ঘটাল? বাতাস যখন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে আসে, পাতা কাঁপে, নদীর জল নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে- এ নীরবতার মালিক কে? আমাদের চারপাশের প্রতিটি দৃশ্য যেন আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর ইচ্ছা, তাঁর পরিকল্পনার প্রতিবিম্ব। ভারী শীতবস্ত্র, কম্বল, আগুন সবই যেন শীতের নির্মম স্পর্শ থেকে রক্ষা পেতে দুর্বল প্রচেষ্টা। এ অনুভূতির মাঝেই লুকিয়ে আছে আল্লাহর পরিচয়ের মহান সুযোগ। আমরা যদি একটু ভেবে দেখি- কী নিপুণভাবে তিনি ঋতুগুলো সাজিয়েছেন! কী দারুণ সব নিয়মে তিনি পৃথিবীর তাপমাত্রা, বাতাসের দিক, সূর্যের দূরত্ব, দিনের দৈর্ঘ্য বদলে দেন! শীতের কাঁপুনি আর গরমের তাপ দুটিই আসলে মানবজাতির ক্ষুদ্রতা ও আল্লাহর মহত্ত্ব তুলে ধরে। যারা এসব নিদর্শন দেখে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে, তারাই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং রাতদিনের আবর্তনে রয়েছে সেই বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শন, যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান-জমিনের সৃষ্টির বিষয়ে গভীর চিন্তা করে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)।

জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনার মৌসুম : মানুষের জীবন মূলত এক নিরন্তর যাত্রা; আল্লাহর আনুগত্য আর তাঁর অবাধ্যতার মাঝখানে দুলতে থাকা এক পরীক্ষা। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করবে, তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যে তাঁর বিধান অমান্য করবে, তার পরিণতি জাহান্নাম। এ জাহান্নাম কোনো সাধারণ শাস্তির স্থান নয়; এটি এমন ভয়াবহ, এমন কঠিন, এমন অসহনীয় স্থান, যার আজাবের মাত্রা কল্পনাতীত।’ আমরা সাধারণত জাহান্নাম শুনলে শুধু আগুনের কথা ভাবি; যা প্রচণ্ড উত্তাপ, দগ্ধ হওয়া, পুড়ে যাওয়া। কিন্তু জাহান্নামের শাস্তি একরূপ নয়; এতে আছে নানা ধরন। যেমন তীব্র আগুনের শাস্তি আছে, তেমনি আছে এমন এক শীত, যার তীব্রতা পৃথিবীর কোনো শীতের সঙ্গে তুলনাই চলে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নামের দুই ভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা তুলে ধরেছেন, ‘জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করল- হে রব! আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে! তখন আল্লাহ তাকে দুই নিঃশ্বাসের অনুমতি দিলেন- একটি গ্রীষ্মে, একটি শীতে। মানুষের মাঝে গ্রীষ্মে যে তীব্র উত্তাপ অনুভূত হয়, তা জাহান্নামের দহনের ছোঁয়া, আর শীতে যে কাঁপুনি-জমানো শীত অনুভব কর, তা জাহান্নামের জামহারির অংশ।’ (বোখারি : ৩২৬০)। শীতের ভোরে যখন হাত জমে আসে, বাতাস হিম হয়ে গালে ধাক্কা মারে, পানির ফোঁটা বরফের মতো মনে হয়, তখন আমাদের মনে পড়া উচিত এ হাদিস। দুনিয়ার শীত এতটাই কষ্টদায়ক, এতটাই অসহ্য মনে হয়, তাহলে জাহান্নামের ‘জামহারির’ মুখোমুখি দাঁড়ানো কী সম্ভব? তাই বলা যায়, আসলে শীত শুধু ঋতু নয়; এটি আমাদের জন্য আত্মজিজ্ঞাসার সময়; নিজের দুর্বলতা বুঝে নেওয়ার ঋতু।

শেষ রাতের ইবাদত দয়ার জানালা : শীতের দীর্ঘ রাত যেন মোমিনের জন্য রহমতের নীরব প্রহর। রাতের গভীরতা যখন ঘনীভূত হয়, তখনই আসমানের দিকে মমতার দরজা খুলে যায়। আল্লাহতায়ালা কাছে নেমে আসেন, আপন বান্দাকে স্নেহভরে ডাকেন, ‘কে আছে- আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে চাইবে, আমি তাকে দেব? কে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (বোখারি : ৬৩২১)। কিন্তু ছোট রাতের ক্লান্তি অজান্তেই এ পবিত্র সময়কে মানুষের হাতছাড়া করে দেয়। গরমের দিনগুলোতে কখন যে শেষ রাত কেটে যায়, মনেই থাকে না। শীত সেই ভুলে যাওয়া মুহূর্তকে আবার ফিরিয়ে আনে। দীর্ঘ রাত, নরম কম্বলের নিচে আরামের আহ্বান, তবু যে কেউ চাইলে সহজেই ঘুম ভেঙে দাঁড়িয়ে যেতে পারে রবের সামনে। তাহাজ্জুদের সে বরকতপূর্ণ সময় যেন শীতের উপহার। কোরআন সেই রাতকে মোমিনের রাত বলে স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘তারা রাতের অল্প অংশেই ঘুমাত; আর শেষ প্রহরে ক্ষমা চাইত।’ (সুরা জারিয়াত : ১৭-১৮)। বরেণ্য তাবেয়ি মিজাদ ইবনে ইয়াজিদ (রহ.) বলতেন ‘যদি রোজার তৃষ্ণা, শীতের দীর্ঘ রাত আর তাহাজ্জুদের মাধুর্য না থাকত, তবে আমি মৌমাছি হয়ে যেতে আপত্তি করতাম না।’ (আয-যুহদ ওয়ার রাকাইক : ২৭৮)। আমের ইবনে আবদে কায়েস (রহ.) এ বলে কাঁদতেন, ‘আমি দুনিয়ার জন্য কাঁদি না; কাঁদি গরমের রোজার তৃষ্ণা আর শীতের রাতের নামাজের জন্য।’ (হিলইয়াতুল আউলিয়া : ২/১০৪)।

দান-খয়রাতের উষ্ণ সুযোগ : শীত এলে আমরা যেমন বাড়তি কম্বল, উষ্ণতাপূর্ণ ঘর আর গা ঢেকে রাখতে ব্যস্ত, তখন আমাদের আশপাশেই থাকে তার উল্টো রূপ। উত্তরাঞ্চলের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, শৈত্যপ্রবাহের দাপট, রাস্তার ধারে ঠান্ডায় জমে যাওয়া মানুষ, স্টেশন-বাজারে একটা শীত-পোশাকের অপেক্ষায় জড়সড় নির্ঘুম রাত কাটায় হাজারও অসহায় বনি আদম। আমরা যখন নরম লেপে ঘুমাই, তারা তখন কনকনে বাতাসে জবুথবু রাত কাটায়। শীত শুধু প্রকৃতির পরীক্ষা নয়, এটি মানবতার পরীক্ষারও। এ সময় আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, সামাজিক কর্তব্য, ধর্মীয় আমানত ও শীতের অন্যতম সদকার কাজ। একটি কম্বল, একটি চাদর, কিংবা একটু ওষুধ আমাদের কাছে সামান্য; কিন্তু কারও জন্য যেন পুরো শীতের সম্বল ও উষ্ণতার পথেয়। কাঁপতে থাকা এক দুঃখী মানুষের গায়ে উষ্ণতা জড়ানোর আনন্দ অন্য কিছুতেই মেলে না।