দশটি সুন্দর মৃত্যু
মুফতি আমিনুল ইসলাম
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চিরন্তন এক সত্যের নাম মৃত্যু। মৃত্যুকে অস্বীকার করেছেন, এমন কোনো সুস্থ মানুষের কথা পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। কারণ, সবকিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ কোরআনে কারিমে এরশাদ করেছেন ‘সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ (আলে ইমরান : ১৮৫)। তাই মৃত্যুকে ভুলে নয়, বরং মৃত্যুর স্মরণেই মোমিনের ঈমান তাজা হয়। প্রত্যেক ঈমানদারই একটি সুন্দর মৃত্যু প্রত্যাশা করে। কারণ, সুন্দর মৃত্যুই যে সুন্দর আখেরাতের ইঙ্গিত। হাদিসে বর্ণিত ১০টি সুন্দর মৃত্যুর কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছি।
১. মৃত্যুর সময় তাওহিদের কালেমা পাঠ করে মৃত্যুবরণ করা। হজরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যার শেষ কথা হবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ : ৩১১৬; মুসতাদরাকে হাকিম ১/৩৫১)।
২. পৃথিবীতে আল্লাহর কালেমাকে সমুচ্চ রাখার জন্য জিহাদে শাহাদতবরণ করা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, (তরজমা) এবং (হে নবী!) যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনও মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত। তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রিজিক দেওয়া হয়।
আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা কিছু দিয়েছেন তারা তাতে প্রফুল্ল। আর তাদের পরে এখনও যারা (শাহাদতে) তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি, তাদের ব্যাপারে এ কারণে তারা আনন্দ বোধ করে যে, (তারা যখন তাদের সঙ্গে এসে মিলিত হবে তখন) তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের কারণেও আনন্দ লাভ করে এবং এ কারণেও যে, আল্লাহ মোমিনদের কর্মফল নষ্ট করেন না। (সুরা আলে ইমরান : ১৬৯-১৭১)।
৩. জিহাদের সফরে বা হজের ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে সে শহীদ। যে আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করেছে সে শহীদ। (মুসলিম : ১২০৬)।
অন্য হাদিসে আছে, ইহরামের হালতে উটের পিঠ থেকে পড়ে একজন ব্যক্তির মৃত্যু হলে আল্লাহর রাসুল (সা.) তার সম্পর্কে বললেন, তাকে বরইপাতাযুক্ত পানি দ্বারা গোসল দাও এবং তার (পরিহিত) দুটো কাপড়েই তাকে কাফন দাও। তবে তার মাথা আবৃত করো না। কেননা, কেয়ামতের দিন সে তালবিয়া পাঠ করতে করতে উত্থিত হবে। (মুসলিম : ১২০৬)।
৪. ইবাদত-বন্দেগি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।
হুজায়ফা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে এবং এটাই হবে তার শেষ আমল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় একদিন রোজা রাখবে এবং এটাই হবে তার শেষ আমল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সদকা করবে এবং এটাই হবে তার শেষ আমল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসনাদে আহমদ ৫/৩৯১)।
৫. শরিয়ত কর্তৃক সংরক্ষিত জিনিসের কোনো একটি রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা।
সায়িদ ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যে তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে তার পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে দ্বীন রক্ষায় নিহত হয়, সে শহীদ। যে তার জীবন রক্ষায় নিহত হয়, সে শহীদ। (আবু দাউদ : ৪৭৭২; তিরমিজি : ১৪১৮)।
৬. মহামারি জাতীয় কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তাউন’ হচ্ছে সব মুসলিমের জন্য শাহাদত। (বোখারি ১০/১৬৫-১৬৭; মুসনাদে আহমদ ৩/১৫০, ২২০)।
৭. সন্তান প্রসবের সময় ও নেফাস অবস্থায় নারী মৃত্যুবরণ করা। উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে নারীর মৃত্যু হলে তা শাহাদত। তার সন্তান তাকে জান্নাতের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ... (মুসনাদে আহমদ ৪/২০১, ৫/৩২৩)।
৮. পানিতে ডুবে, আগুনে পুড়ে কিংবা ভূমিধসে মৃত্যুবরণ করা। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, শহীদ পাঁচ শ্রেণির : প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণকারী, পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী, পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী, ভূমিধসে মৃত্যুবরণকারী আল্লাহর পথের শহীদ। (তিরমিজি : ১০৬৩; মুসলিম : ১৯১৫)।
হজরত জাবির ইবনে ওতাইক বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালার পথে নিহত হওয়া ছাড়া আরও সাত শ্রেণির শহীদ আছেন। যথাÑ
প্লেগ রোগে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, যাতুল জাম্বে (ফুসফুসের একটি বিশেষ ব্যাধি) মৃত্যুবরণকারী শহীদ, পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী শহীদ, আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ধসের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মৃত্যুবরণকারী নারী শহীদ। (মুসনাদে আহমদ ৫/৪৪৬; আবু দাউদ : ৩১১১; নাসায়ি ৪/১৩-১৪)।
৯. জুমার দিন বা রাতে মৃত্যুবরণ করা। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোনো মুসলিম শুক্রবার দিনের বেলা কিংবা রাতে মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের ফেতনা থেকে মুক্তি দান করেন। (মুসনাদে আহমদ ২/১৬৭; তিরমিজি : ১০৮০)।
১০. মৃত্যুর সময় কপাল ঘর্মাক্ত হওয়া। হোসাইব থেকে বোরায়দা বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ঈমানদার মৃত্যুবরণ করে কপাল ঘর্মাক্ত অবস্থায়। (তিরমিজি : ৯৮২; নাসায়ি ৪/৬)।
এছাড়া সুন্দর মৃত্যুর আরও নিদর্শন রয়েছে। আমরা প্রসিদ্ধ ১০টি উল্লেখ করলাম। সুতরাং এসব মৃত্যু যারা লাভ করবেন, তাদের ব্যাপারে আমরা সুধারণা অবশ্যই পোষণ করব। কিন্তু যারা এর ব্যতিক্রম মৃত্যু বরণ করবেন, তাদের ব্যাপারে কোনো ধরনের অমূলক মন্তব্য করব না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সুন্দর মৃত্যু নসিব করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
