ইসলামে অভিবাদন কী কেন কীভাবে
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা

অভিবাদন বা সম্ভাষণ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো সম্মান প্রদর্শন, বন্দনা, সালাম, অভ্যর্থনা, অভিনন্দন ইত্যাদি। আরবিতে এর প্রতিশব্দ (তাহিয়্যাহ)। আভিধানিক অর্থ হলো জীবনের জন্য দোয়া করা। ইংরেজিতে এৎববঃরহম, ঝধষরঃরড়হ, ঝধষঁঃব, ঈযববৎ, ডবষপড়সব. ইসলামি পরিভাষায়- পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় একে অন্যের জন্য কল্যাণ কামনার্থে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলাকে অভিবাদন বলা হয়।
বিশ্বের সব জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পরের শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রথা চালু আছে। ইসলামে পারস্পরিক অভিবাদন বা শুভেচ্ছা বিনিময়ের কল্যাণময় যে বিধান চলমান রয়েছে তা হলো- ‘আসসালামু আলাইকুম’। যার মাঝে নিহিত রয়েছে নিরাপত্তার সুমহান ঘোষণা, কল্যাণ কামনার সমধুর বার্তা, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন, শান্তি ও শৃঙ্খলার অনুপম দৃষ্টান্ত, ভক্তি ও শ্রদ্ধার সরব সম্ভাষণ, আদর ও স্নেহের শীতল অভিবাদন, মঙ্গল কামনার অকপট শুভেচ্ছা। ‘সালাম’ মহান আল্লাহ তায়ালার সুন্দর নামগুলোর অন্যতম একটি।
অভিবাদনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর সূচনা হয় আমাদের আদিপিতা আদম (আ.) এর সৃষ্টির পর থেকেই। তবে এ অভিবাদন ছিল ‘ইসলামি অভিবাদন’ অর্থাৎ ‘সালাম’। আদম (আ.) সৃষ্টির পর মহান রাব্বুল আলামিন তাকে ইসলামি অভিবাদন শিক্ষা দেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে- ‘আল্লাহ তায়ালা আদম (আ.) কে স্বীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করলেন। তার উচ্চতা ছিল ৬০ হাত। তাকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালা বললেন, যাও! ওই দলটিকে সালাম দাও। তারা ফেরেশতাদের উপবিষ্ট একটি দল। তারা তোমার অভিবাদনের যে উত্তর দেন, তা তুমি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করো। কেননা তা তোমার ও তোমার বংশধরদের জন্য অভিবাদন হবে। তখন আদম (আ.) গেলেন এবং বললেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ (আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)। ফেরেশতারা জবাবে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ (আপনার ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক)’। রাসুল (সা.) বলেন, ফেরেশতারা অভিবাদনের জবাবে ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বৃদ্ধি করেছিলেন।’ (বোখারি : ৬২২৭, মুসলিম-২৮৪১)।
যুগে যুগে সব নবী-রাসুল ইসলামি অভিবাদন হিসেবে সালামকে ব্যবহার করেছেন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আইয়ামে জাহেলিয়ায় লোকেরা এ অভিবাদনকে পরিবর্তন করে বিভিন্ন বাক্যে যেমন : ‘আনয়ামা আল্লাহ বিকা আইনান’ ‘আনয়ামা সবাহান’ প্রভৃতির মাধ্যমে অভিবাদন জ্ঞাপন করত। মহানবী (সা.) এগুলো বলাকে নিষেধ করলেন এবং সালামের প্রচলনের ব্যাপারে তাগিদ দিলেন। এ প্রসঙ্গে ইমরান ইবনে হুসাইন বলেন : “আমরা জাহেলি যুগে অভিবাদন হিসেবে ‘আনয়ামা আল্লাহ বিকা আইনান’ ‘আনয়ামা সবাহান’ বলতাম। এরপর যখন ইসলাম আগমন করল, তখন আমাদের এরূপ বলা নিষেধ করা হলো।” (সুনানে আবু দাউদ-৫২২৭)।
অভিবাদনের শব্দাবলিকে দুই ভাগে বিভক্ত
করা যেতে পারে :
১. অভিবাদনের সাধারণ শব্দাবলি
২. অভিবাদনের ইসলামী শব্দাবলি।
১. অভিবাদনের সাধারণ শব্দাবলি : সাধারণ অভিবাদনের ক্ষেত্রে শুভ সকাল/এড়ড়ফ গড়ৎহরহম, শুভ সন্ধ্যা/এড়ড়ফ ঊাবহরহম, আল্লাহ তোমার চোখকে শীতল করুন, এড়ড়ফ ঘরমযঃ, ঐবষষড়, ঐর প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে।
২. অভিবাদনের ইসলামি শব্দাবলি : অভিবাদনের ইসলামি শব্দাবলি আমরা নিম্নোক্ত হাদিস থেকে পেতে পারি : ইমরান ইবনে হোসাইন থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.) এর কাছে এলো এবং বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম’। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসল। তখন রাসুল (সা.) বললেন, (এ লোকটির জন্য) ১০টি সওয়াব। অতঃপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসল। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ২০টি সওয়াব। এরপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ ওয়াবারাকাতুহু’। তিনি তার সালামের জবাব দিলেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ৩০টি সওয়াব। (সুনানে আবু দাউদ-৫১৯৫, দারেমি-২৫২৬)।
এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেল, অভিবাদনের ইসলামি শব্দাবলি হলো, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।’ তবে সংক্ষিপ্তাকারে আমাদের মাঝে ‘আসালামু আলাইকুম’ সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। ইসলামি অভিবাদনের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলতে হয়। তবে উত্তম হলো সালাম প্রদানকারী যে বাক্যের মাধ্যমে সালাম দেবে সালামের জবাবদানকারী তার থেকে অধিক শব্দের মাধ্যমে জবাব দেবে। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আর যখন তোমাদের অভিবাদন জানানো হয়, তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম অভিবাদন প্রদান করো অথবা অনুরূপ ফিরিয়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ (সুরা নিসা : ৮৬)।
ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ ইসলামের অন্যতম শিয়ার। সব ওলামায়ে কিরামের ঐকমত্যে, এক মোমিন অপর মোমিনকে সালাম দেওয়া সুন্নাত এবং এর জবাব দেওয়া ওয়াজিব। যখন সালাম দ্বারা এক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করা হয়। আর যদি সালামের দ্বারা কোনো দল বা সমষ্টিকে উদ্দেশ্য করা হয় তাহলে তার জবাব দেওয়া ওয়াজিবে কেফায়াহ। তবে যদি সবাই উত্তর দেয় তা হলে অতি উত্তম। কারও কারও মতে, সালাম দেওয়ার মতো এর জবাব দেওয়াও সুন্নাত। সালাম দেওয়া সুন্নাত এ বিষয়টি রাসুল (সা.) এর অগণিত হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। আর এর জবাব দেওয়া সুরা নিসার উল্লিখিত ৮৬নং আয়াত দ্বারা ওয়াজিব হিসেবে প্রমাণিত। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, কোনো মুসলিম সালাম দিলে উত্তর দেবে তার চেয়ে উত্তমভাবে অথবা তার মতো করে। বাড়িয়ে বলা মোস্তাহাব, আর তার মতে, উত্তর দেওয়া ফরজ।
ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে এর ব্যবহার রীতি সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপিত হলো :
১. কথাবার্তা শুরু করার আগে সালাম দেওয়া অপরিহার্য। মহানবী (সা.) বলেছেন ‘কথা বলার পূর্বে সালাম।’ (জামে তিরমিজি-২৬৯৯। ইমাম তিরমিজি বলেছেন, এ হাদিসটি মুনকার হাদিস)। অপর হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি যে প্রথমে সালাম দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-৫৯৯৭)।
২. সাক্ষাতের সময় : এক মোমিনের সঙ্গে অপর মোমিনের সাক্ষাৎ হলে ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ দিতে হয়। সালাম দেওয়া রাসুল (সা.) এক মোমিনের জন্য অন্য মোমিনের কর্তব্য বা হক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাদিসে বর্ণিত, এক মোমিনের জন্য অন্য মোমিনের প্রতি ছয়টি কর্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো : যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তখন তাকে সালাম দেবে। (জামে তিরমিজি-২৭৩৭)।
৩. অন্যের বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার সময় : কারও বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার জন্য সালাম প্রদান করার ব্যাপারে কোরআনে এসেছে- ‘হে মোমিনরা! তোমরা নিজেদের বাড়ি ব্যতীত অন্য কারও বাড়িতে অনুমতি ও সালাম প্রদান ব্যতীত প্রবেশ করবে না।’ (সুরা নূর-২৭)। পর পর তিনবার সালাম প্রদানের পর অনুমতি না পেলে ফিরে যাওয়াই ইসলামি শিষ্টাচার।
৪. আগমন ও প্রস্থানের সময় : আগমন ও প্রস্থানের সময় ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ দিতে হবে। আবু হুরায়রা ও জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো সমাবেশে পৌঁছে, তখন সে যেন সালাম দেয়। যদি তথায় তার বসার প্রয়োজন হয়, তবে যেন বসে পড়ে। অতঃপর যখন সে প্রস্থানের জন্য দাঁড়ায়, তখন যেন সালাম করে। কেননা, প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালামের চেয়ে অধিক হকদার নয়।’ (জামে তিরমিজি-২৭০৬, সুনানে আবু দাউদ-৫২০৮)।
৫. নিজের বাড়িতে প্রবেশকালে : নিজের বাড়িতে প্রবেশকাল পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ প্রদান করা সুন্নাত। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন স্বরূপ সালাম পেশ করবে।’ (সুরা নূর-৬১)। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে বৎস! যখন তোমার বাড়িতে প্রবেশ করবে, তখন সালাম দেবে। কেননা, তোমার সালাম তোমার ও তোমার পরিবারের লোকদের জন্য বরকতের কারণ হবে।’ (জামে তিরিমিজি -২৬৯৮)।
ইশারা-ইঙ্গিতে ইসলামি অভিবাদন : হাতের তালু, আঙুল বা মাথার ইশারা-ইঙ্গিতে ইসলামি অভিবাদন বা সালাম প্রদান করা বা জবাব দেওয়া মাকরুহ। কেননা ইশারা-ইঙ্গিতে অভিবাদন জানানো ইহুদি-নাসারাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। তোমরা ইহুদি ও নাসারাদের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখবে না। কেননা, ইহুদিরা আঙুলের ইশারায় এবং নাসারারা হাতের তালুর ইশারায় সালাম প্রদান করে থাকে।’ (জামে তিরমিজি-২৬৯৫)।
ইমলামি অভিবাদনের নিষিদ্ধ সময় : বিভিন্ন সময় ইসলামি অভিবাদন প্রদান করা উচিত নয়। যথা- প্রাকৃতিক কাজ সারার সময়, ঘুমন্ত অবস্থায়, নামাজরত অবস্থায়, গোসলখানায় গোসলরত অবস্থায়, খাবার গ্রহণের সময়, কোরআন তেলাওয়াতকালীন, খুতবা চলাকালীন, ইহরাম অবস্থায় তালবিয়া পাঠকালে।
মহানবী (সা.) এর হাদিস দ্বারা আমরা ইসলামি অভিবাদন ‘সালাম’ প্রদানের সুন্নাতসম্মত পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হতে পারি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আরোহী ব্যক্তি পথচারী ব্যক্তিকে, পথচারী ব্যক্তি উপবিষ্ট ব্যক্তিকে, কম সংখ্যক ব্যক্তি বেশিসংখ্যক ব্যক্তিকে সালাম দেবে।’ (বোখারি-৬২৩২/৬২৩৩, মুসলিম-২১৬০)। ‘ছোট বড়কে, পথচারী উপবিষ্ট ব্যক্তিকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করবে।’ (বোখারি-৬২৩১/৬২৩৪)।
আমাদের সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুযায়ী আজকাল কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে হায়-হ্যালো দিয়ে অভিবাদন জানায়। আমাদের উচিত পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সালাম দিয়ে কথা শুরু করা। শুধু সাক্ষাতেই নয়, ফোন, মোবাইল, ফেইসবুক, ই-মেইলসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কথা বলা বা পত্রালাপ করার সময় সালাম দিয়ে কথা শুরু করা মুসলিম হিসেবে নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। হায়-হ্যালো ইত্যাদি পশ্চিমা সংস্কৃতি বর্জন করা উচিত। কেননা সালামের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, হৃদ্যতা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা সৃষ্টি হয় এবং অন্তর থেকে বিদুরিত হয় অহংকার, কৃপণতা, লৌকিকতা, প্রদর্শনেচ্ছার মতো মানবিক দুর্বলতা।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
