সাগরের আয়তন ও গভীরতা যেমন বিশাল, বিস্তীর্ণ এবং বিস্ময়কর। তেমনি এর বৈচিত্র্যময় প্রাণী সংখ্যারও যেন ইয়ত্তা নেই। সাগরে কত জাতের কত বর্ণের জলজ প্রাণী ও মাছ যে বিচরণশীল তা এই সুবিশাল সাগরের স্রষ্টা একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালাই সম্যক জ্ঞাত। আমাদের বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির (মোহনাজলসহ) এবং প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। সাগরের মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে লাক্ষা, কৈ, কোরাল, দাতিনা কোরাল, রেড সøাপার। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ যেমন ভেটকি, সুরমা, কাটল ফিশ, দেশি স্কুইড, রুপচাঁদা, ম্যাকারে, শ্রিম্প, টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, স্কুইড, লবস্টার, কোরাল, কড ইত্যাদির দেখা মেলে।
সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা : মাছ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর ফ্যাটি এসিড। এই ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্ক, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মাছ মানুষের হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ককে কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। যেসব কারণে হৃদযন্ত্র অচল ও অকার্যকর হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মাছের উপাদানগুলো। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান, তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে ড. মোজাফফারিয়ান আরও জানান, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দুইবার মাছ খান তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ মূল্যবান উপাদানের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে মাছের তেল। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের রিদম বা ছন্দকে দ্রুততর করে, ধমনিতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনিতে পুরোনো প্রদাহকে ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে ও রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামুদ্রিক মাছ শুধু আপনার হৃদযন্ত্রের জন্যই উপকারী নয়, এটা আপনার মস্তিষ্ককেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। যারা সামুদ্রিক মাছ বেশি খান তাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এ কমে যাওয়ার হার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের দুটি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডুপামাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দুটি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।
পবিত্র কোরআনে সামুদ্রিক মাছের বর্ণনা : পবিত্র কোরআনেও সামুদ্রিক মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক প্রসঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাংস খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। তুমি তাতে জলযানগুলোকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর।’ [সুরা আন-নাহল : ১৪]।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দুইটি সমুদ্র সমান হয় না একটি মিঠা ও তৃষ্ণানিবারক এবং অপরটি লোনা। উভয়টি থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মৎস্য) আহার কর এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ কর। তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [সুরা আল-ফাতির : ১২]।
বক্ষমান আয়াতদ্বয়ে সাগরের মাছকে আল্লাহ তায়ালা তাজা গোশত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাজা গোশতের উপকারিতার শেষ নেই। তাজা গোশত মূলত পূর্বোক্ত সামুদ্রিক মাছের বহুবিধ উপকারিতারই ইঙ্গিত করছে। সামুদ্রিক বড় বড় মাছের হাড় দিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও আসবাব বানানো হয়। আল্লাহ তায়ালা সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন আয়াতদ্বয়ে। আর সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল ও শামুকে মুক্তো পাওয়া যায়, যা মূল্যবান অলংকারাদিতে শোভা বৃদ্ধি করে। তাছাড়া মানুষের উপকারার্থেই আল্লাহ তায়ালা সাগর ও এর উদরস্থ যাবতীয় সামগ্রী প্রস্তুত করেছেন। তাই তিনি এর শিকার ও তার গোশত ভক্ষণ বৈধ আখ্যা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে এবং তোমাদের এহরামকারীদের জন্য হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার যতক্ষণ এহরাম অবস্থায় থাক। আল্লাহকে ভয় কর, যার কাছে তোমরা একত্রিত হবে।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৯৬]।
মানব ইতিহাসের সূচনা থেকেই দেখা গেছে, সমুদ্র তীরের মানুষ তাদের জীবিকার সন্ধানে সাগর ভ্রমণ করেছেন। সাগরের পানির পবিত্রতা, এর প্রাণী শিকার ও মাছের গোশত আহারের বৈধতা ঘোষিত হয়েছে রাসুলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবানেও। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা সমুদ্র বিহার করি। আমাদের সঙ্গে যৎসামান্য পানি থাকে। তা দিয়ে যদি আমরা অজু করি, তাহলে পিপাসার্ত হয়ে যাব। আমরা কি তাহলে সাগর থেকে (এর পানি দিয়ে) অজু করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এর (সাগরের) পানি পবিত্র এবং এর মৃত হালাল।’