
আল্লাহতায়ালা মানুষের জীবনে দুটি দুর্বলতার মাঝে একটি শক্তি রেখেছেন। সেই শক্তিটি পার্থিব জীবনের ভিত্তি ও পরকালের মুনাফা অর্জনের মাধ্যম। প্রথম দুর্বলতার পর সেই শক্তিটি যৌবনকাল। এ সময়ে দৃঢ়তা ও স্বপ্নগুলো প্রস্ফুটিত হয়। যুগ যুগ ধরে যুবকদের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। ইব্রাহিম (আ.) সম্পর্কে তার জাতি বলেছিল, ‘আমরা এক যুবককে তাদের সম্পর্কে বিরূপ আলোচনা করতে শুনেছি, তাকে ইব্রাহিম বলা হয়।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬০)। আসহাবে কাহাফ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।’ (সুরা কাহাফ : ১৩)।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। সেই যুবক শ্রেণি তাদের অন্যতম, যাদের জীবন গড়ে উঠেছে আল্লাহর আনুগত্যে।’ (বোখারি : ৬৮৯৪)। তরুণ ও যুবক সাহাবিদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ ছিল অত্যন্ত মহান। তিনি তাদের প্রতি বিনয়াবনত হয়েছেন। সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের সঙ্গে বসেছেন। নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। শিখিয়েছেন। তাদের সাহস বাড়াতে সাহায্য করেছেন। ফলে তাদের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম জাতি উপহার পেয়েছে।
যুবকদের সঙ্গে (সা.)-এর বিনয়ী আচরণ ছিল। এর অন্যতম উদাহরণ হলো, জুনদুব ইবনে আবদিল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা কয়েকজন শক্তিশালী উঠতি যুবক রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা কোরআন শেখার আগে ঈমান শিখেছি। এরপর কোরআন শিখেছি। তা দ্বারা ঈমান আরও বাড়িয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ : ৬৪)। রাসুল (সা.) যুবকদের হৃদয়ে ইসলামি আকিদা দৃঢ়ভাবে স্থাপন করাতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমরা একদিন রাসুল (সা.)-এর পেছনে ছিলাম। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি আল্লাহর বিধিনিষেধ মেনে চলবে। আল্লাহ, ?তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর হক রক্ষা করবে, তাহলে আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে। তুমি কিছু চাইলে একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে।’ (তিরমিজি : ২৫১৬)।
যুবকদের শিক্ষাদানে বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে রাসুল (সা.) আন্তরিকতা প্রকাশ করতেন। কখনও তাদের হাত ধরতেন। যেমন মুয়াজ (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমার হাত ধরলেন। বললেন, ‘তোমাকে ভালোবাসি।’ মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি কি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দেব না, যা তুমি তোমার প্রত্যেক সালাতের পরে পাঠ করবে?’ মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘তুমি আল্লাহর কাছে বলবে, হে আল্লাহ! আপনার স্মরণে, কৃতজ্ঞতায় ও উত্তম আমলে আমাকে সাহায্য করুন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৫২২)। আবার কখনও তিনি তাদের হাত নিজের দু’হাতে নিতেন। যেমন ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার হাত তার উভয় হাতে নিয়ে তাশাহুদ শিখিয়েছেন। যেমনিভাবে আমাকে তিনি কোরআনের সুরা শেখাতেন।’ (বোখারি : ৬৩৩৮)। আবার কখনও তিনি তাদের কাঁধে হাত রাখতেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবন ওমর (রা.) বলেন, একদিন রাসুল (সা.) আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করো, যেন তুমি একজন মুসাফির বা পথচারী।’ (বোখারি : ৬৪৯২)। তিনি ধৈর্য ধরে তাদেরকে শেখাতেন। যেমন জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে ইস্তেখারা শেখাতেন, যেভাবে শেখাতেন কোরআনের সুরা।’ (বোখারি : ৬৪৫৫)।
রাসুল (সা.) যুবক সাহাবাদের ইবাদত পালনে উদ্বুদ্ধ করতেন। একদিন আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.)-কে বললেন, ‘আবদুল্লাহ! লোকটি কতই না ভালো কাজ করত, যদি সে রাতের বেলা সালাত আদায় করত!’ এরপর থেকে আবদুল্লাহ (রা.) রাতে কম সময় ঘুমাতেন।’ (বোখারি : ১১৫৬)। তিনি তাদেরকে সুন্দর ভাষায় নির্দেশনা ও উপদেশ দিতেন। একদিন রাসুল (সা.) খুরাইম উসাইদ (রা.)-কে বললেন, ‘হে খুরাইম! তুমি লোকটি কতোই না ভালো, যদি দুটি অভ্যাস তোমার মধ্যে না থাকত!’ খুরাইম উসাইদ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! সে দুটি কি?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলে পড়া ও মাথার চুল লম্বা রাখা।’ এরপর থেকে খুরাইম (রা.) এ দুটি অভ্যাস ত্যাগ করলেন। রাসুল (সা.) তাকে স্নেহ করতেন। তার পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। (মুসনাদে আহমদ : ৩২২)।
মালিক বিন হুয়াইরিস (রা.) বলেন, আমরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হলাম। বিশ দিন ও বিশ রাত আমরা তার কাছে অবস্থান করলাম। তিনি ভাবলেন, আমরা হয়তো আমাদের পরিবারের কাছে যেতে আগ্রহী। তাই জিজ্ঞেস করলেন, আমরা পরিবারের কাদেরকে রেখে এসেছি! আমরা তাকে সে ব্যাপারে জানালাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও বিনয়ী স্বভাবের। তিনি বললেন, ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তাদের দ্বীন শিক্ষা দাও। তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ, সেভাবে সালাত আদায় করো।’ (বোখারি : ৫৫৮৩)।
রাসুল (সা.) যুবকদের প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। এমন পরামর্শ দিতেন, যাতে তাদের নিজের ও জাতির কল্যাণ রয়েছে। রাসুল (সা.) মদিনায় আগমন করে দেখলেন, জায়েদ বিন সাবেত (রা.)-এর হাতের লেখা খুবই সুন্দর। তিনি তাকে পবিত্র ওহির লেখক হিসেবে নিয়োগ দেন। তার তীক্ষè মেধা দেখে রাসুল (সা.) তাকে ইহুদিদের ভাষা রপ্ত করতে বললেন। যেন তাদের ভাষায় লিখিত বিষয়গুলো তার কাছে অনুবাদ করতে পারেন। রাসুল (সা.) তার যুবক সাহাবিদের কাছ থেকে কোরআন শিখতে উৎসাহ দিতেন। বলতেন, ‘তোমরা চারজনের কাছ থেকে কোরআন শেখো, ইবনে মাসউদ, মুয়াহ বিন জাবাল, উবাই বিন কাব ও আবু হুজাইফার ক্রীতদাস সালেম।’ (বোখারি : ৪৯৯৯)।
রাসুল (সা.) যুবকদের প্রশংসা করতেন। তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের মর্যাদা প্রকাশ করতেন। মুয়াজ (রা.)-এর মাঝে ফিকহি জ্ঞান দেখে বলতেন, ‘যুবকদের মধ্যে হালাল-হারাম সম্পর্কে মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) বেশি অভিজ্ঞ।’ (সুনানু আবি দাউদ : ১৫২২)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি একে কিতাবের জ্ঞান দান করুন।’ (বোখারি : ৭০৫৪)। তিনি তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতেন। তাদের বিপদগ্রস্ত হওয়াকে গুরুতর ভাবতেন। মক্কায় যারা প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন যুবক। মদিনায় হিজরতের আগে যারা মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং দু’বার রাসুল (সা.)-এর কাছে শপথ গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অর্ধেকের বেশিই ছিলেন যুবক। রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম মদিনায় দাওয়াত ও ইসলামি শিক্ষার জন্য যুবক সাহাবি মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-কে পাঠান। তিনি সেখানে গিয়ে অন্য এক যুবক সাহাবি আসআদ বিন জুরারা (রা.)-এর কাছে আশ্রয় নেন। হিজরতের সময় রাসুল (সা.) যুবক সাহাবি আলী (রা.)-কে তার কাছে গচ্ছিত আমানত মক্কাবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করে যান। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করা প্রায় সব সাহাবি ছিলেন যুবক। বদর যুদ্ধে রাসুল (সা.) যখন আহ্বান করলেন, তখন যুবক সাহাবিরাই যুদ্ধে অংশ নেন। এভাবেই যুবকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন।
১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৪ জানুয়ারি ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আল মামুন নূর