ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পরম বন্ধুর গল্প

পরম বন্ধুর গল্প

মানুষের ব্যবহার-আচারের পরীক্ষা হয় তখন, যখন সমবয়সি ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তার লেনদেন-ওঠবস হয়। বিশেষ করে, যখন তাকে আল্লাহতায়ালা সমবয়সি ও সমকালীন লোকদের তুলনায় অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে যান, তখন সাধারণত যোগ্যতা ও প্রতিভাধারী মানুষ নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করতে উদগ্রীব থাকে। অন্যদের নীচুভাবে দেখতে আরম্ভ করে। কিন্তু রাসুল (সা.) ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তার জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব : ২১)। তার অনুপম চরিত্রের বিবরণ দিয়ে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম : ৪)।

বন্ধুর মুখে বন্ধুর প্রশংসা

সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল থেকে উত্তম চরিত্রের আর কাউকে দেখিনি।’ (আল মুজামুল আওসাত লিত তাবারানি : ৬৫৮০)। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে উত্তম আচরণেও রয়েছে তার অনুপম আদর্শ। রাসুল (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ বন্ধু। তিনি বন্ধু-বান্ধবকে খুব ভালোবাসতেন। তাদের ভালো দিকগুলোর স্বীকৃতি দিতেন। তাদের বিশেষ গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য থাকলে বর্ণনা করতেন। আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘দুনিয়ায় তারা আমার মন্ত্রী।’ ওসমান (রা.)-এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তিনি অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির।’ আলী (রা.)-এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘আমি ইলমের শহর, আর আলী (রা.) এর দরোজা।’ জোবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.)-কে নিজের হাওয়ারি (একনিষ্ঠ সঙ্গী) আখ্যায়িত করেছেন। আবু উবাইদা ইবনে জাররা (রা.)-কে উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘যে বিষয়টি তার পছন্দ, আমিও তা আমার উম্মতের জন্য পছন্দ করলাম।’ ইজ্জত-সম্মানের অনেক বাক্য তিনি বন্ধু-বান্ধবের জন্য ব্যবহার করেছেন।

বন্ধুমহলের নজরকাড়া

উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা বোঝা গেল, একজন মুসলমানের ভেতর যেন নিজের সমকালীন সমবয়সি লোকদের গুণাবলি, যোগ্যতা, প্রতিভা, কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি দেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। অবশ্য এতে বাড়াবাড়ি যেন না হয়ে যায়, খেয়াল রাখতে হবে। রাসুল (সা.) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল। এ সত্ত্বেও তিনি তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে খুব গভীর সম্পর্ক রাখতেন; যে সম্পর্ক পরিবারের এক সদস্য আরেক সদস্যের সাথে রাখে। তার আচরণ অনেক মোহনীয় ছিল। সবাই মনে করত, তিনি তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা প্রকাশার্থে মাঝেমধ্যে তিনি তাদের নিয়ে একসঙ্গে বসে খাবার খেতেন। সবকিছুতে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। সুখে-দুঃখে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন। এ জন্য সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল।

সুখে-দুঃখে বন্ধুর পাশে থাকা

তিনি নিজেই অল্পে তুষ্টির জীবনযাপন করতেন। কখনও কখনও অনাহারে কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু এরপরও তিনি সঙ্গীদের আর্থিক সাহায্যের দিকে খেয়াল রাখতেন। কোনো হাদিয়া-উপঢৌকন এলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। আর রমজান মাসে তো তার দান-দাক্ষিণ্য প্রবল বাতাসের চেয়েও বেড়ে যেত। তিনি বন্ধু-বান্ধবের প্রয়োজন মেটানোর পূর্ণ চেষ্টা করতেন। এক সাহাবির খেজুরের ফসল নষ্ট হয়ে গেল। তার অনেক ঋণ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বন্ধু-বান্ধবকে বললেন, ‘তাকে সাহায্য করো।’ লোকজন সাহায্য করল। ঋণ শেষ হলো না। রাসুল (সা.) ঋণদাতাদের বললেন, ‘যা আছে, নিয়ে নাও। তোমাদের তো এতটুকুই পাওনা।’

বিপদাপদে বন্ধুকে মানসিক সহায়তা প্রদান

কোনো সঙ্গী অসুবিধায় পড়লে রাসুল (সা.) তাকে সান্ত¡না দিতেন। তার মন জোগানোর চেষ্টা করতেন। কঠিন কঠিন কাজে নিজেও সাহাবিদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতেন। খন্দক যুদ্ধের সময় শীতকাল হওয়ার কারণে প্রচুর ঠান্ডা পড়েছিল। সাহাবিরা ক্ষুধা-পিপাসা নিয়েই খননের কাজে মশগুল ছিলেন। ক্ষুধায় একেকজন অস্থির হয়ে যেতেন। এমন সময় রাসুল (সা.) এসে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, (প্রকৃত) আরাম-আয়েশ তো আখেরাতেরই আরাম-আয়েশ। আনসার ও মুহাজিরদের আপনি ক্ষমা করুন।’ তিনি সবার সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে থাকতেন, যেন তাদেরই একজন। তিনি শিশুদের পাশ দিয়ে গেলে তাদের সালাম দিতেন। তারা তাকে হাত ধরে যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যেত। তিনি দরিদ্র-অসহায় মানুষের পাশে বসতেন। অসুস্থদের সেবা করতেন। জানাজায় উপস্থিত হতেন। দাফনেও শরিক হতেন। তিনি বিধবা নারীদের সাহায্য পূরণে এগিয়ে আসতেন। সমাজে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যারা বিধবা নারীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে, তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজ ও সদা রোজা পালনকারী।’ (বোখারি : ৬০০৭)।

বন্ধু ও সমবয়সিদের গুরুত্ব দেওয়া

সমবয়সিদের কাছ থেকে কোনো কষ্ট পেলেও তিনি তা সহ্য করে নিতেন। প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। শুধু এটাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের পরামর্শে রাখতেন। তাদের খুশি করে কাজে মনোযোগ সৃষ্টি করাতেন। নইলে তার কাজ তো সব ছিল অহিনির্ভর। এতে পরামর্শের প্রয়োজন ছিল না। নিজ প্রিয়জনদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের কারণে সাহাবায়ে কেরামের অন্তর রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসায় টইটম্বুর ছিল। নিজ সমবয়সি অনুচরদের সঙ্গে উত্তম ও সৌজন্য রক্ষার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত রাসুল (সা.)-এর সুমহান চরিত্র।

লেখক : সহকারী মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত