ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

আল্লাহর আনুগত্য করবেন যেভাবে

শায়খ ড. আলী বিন আবদুর রহমান আল হুজাইফি
আল্লাহর আনুগত্য করবেন যেভাবে

মানুষের ইহ-পরকালীন সফলতা নির্ভর করে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর। আল্লাহর আনুগত্য হচ্ছে, তাঁর আদেশ মেনে চলা এবং নিষেধ থেকে নিজেকে হেফাজত করা। যারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলে এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে, তারাই তাঁর প্রকৃত অনুগত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ মানবে, যাদের প্রতি আল্লাহতায়ালা নেয়ামত দান করেছেন, সে তাদের সঙ্গী হবে। তারা হলো- নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি। তাদের সান্নিধ্য হলো, উত্তম। এটা আল্লাহপ্রদত্ত মহত্ত্ব। আর আল্লাহই সম্যক অবগত।’ (সুরা নিসা : ৬৯-৭০)। যে ব্যক্তি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট বিষয় মেনে চলে এবং অন্যায়-অপরাধ ও গোনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে, সে-ই প্রকৃত অনুগত। আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে নেক আমল বিনষ্ট হয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানে ঘাটতি আসে। এমনকি কখনও কখনও উত্তম আমল বাতিল হয়ে যায়। যারা আল্লাহর আনুগত্য করতে চায়, তাদের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট কোরো না।’ (সুরা মুহাম্মদ : ৩৩)। আমল ধ্বংস করা যাবে না। অর্থাৎ আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য বরবাদ করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) বলুন, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি। আরও আদিষ্ট হয়েছি, সর্বপ্রথম নির্দেশ পালনকারী হওয়ার জন্য। বলুন, আমি আমার পালনকর্তার অবাধ্য হলে এক মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি। বলুন, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করি।’ (সুরা যুমার : ১১-১৪০)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওই নারীর মতো হয়ো না, যে পরিশ্রমের পর কাটা সুতা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে।’ এ উদাহরণ প্রত্যেক এমন ভালো কাজের জন্য, যা সম্পাদনের পর খারাপ কাজের মাধ্যমে সেই ভালো কাজকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

আল্লাহর নাফরমানি উত্তম আমলকে ধ্বংস করে দেয়

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কেউ পছন্দ করে যে, তার একটি খেজুর ও আঙুরের বাগান হবে। এর তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে। আর এতে সব ধরনের ফল-ফসল থাকবে। সে বার্ধক্যে পৌঁছাবে। তার দুর্বল সন্তান-সন্তুতিও থাকবে। এ অবস্থায় এ বাগানের একটি ঘূর্ণিবায়ু আসবে, যাতে আগুন রয়েছে। অনন্তর বাগানটি ভষ্মীভূত হয়ে যাবে। এমনিভাবে আল্লাহতায়ালা তোমাদের কাছে তাঁর নিদর্শন বর্ণনা করেন; যেন তোমরা চিন্তা-ভাবনা করো।’ (সুরা বাকারা : ২৬৬)। মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, ‘এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা এমন ভালো কাজের কথা বর্ণনা করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে গোনাহের কারণে বরবাদ হয়ে যায়।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি জানি, আমার উম্মতের কিছু লোক কেয়ামতের দিন সাদা পাহাড়ের মতো আমল নিয়ে আসবে। অতঃপর আল্লাহ তাদের বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন।’ আবু সুফিয়ান (রা.) রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘এমন লোকদের ব্যাপারে আমাদের বিস্তারিত বলুন; যেন আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘এরা তোমাদের সঙ্গেই থাকে। তোমাদের সঙ্গেই রাতের ইবাদতে শরিক হয়। কিন্তু যখনই একাকী আল্লাহর নাফরমানি করার সুযোগ পায়, তখন গোনাহ করে এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচুন

আল্লাহতায়ালা কল্যাণ ও বরকতের মাস রমজানে আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য সাহায্য ও সাফল্য দান করেছিলেন। তিনি বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আমরা কল্যাণের সাহায্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলাম। রমজানের সময়গুলো আমাদের জন্য বরকতময় করা হয়েছিল। এর সময়গুলো আমাদের জন্য উত্তম ছিল। আমরা কোরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণ উপভোগ করেছি। অন্তর পরম করুণাময়ের আনুগত্য দ্বারা পরিশুদ্ধ হয়েছে। আল্লাহতায়ালা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আমাদের আত্মাকে দমন করতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু বিতাড়িত শয়তান রমজানের পর তার বন্দিদের মুক্ত করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে। সে আল্লাহর প্রতি আমাদের ভীতি দূর করে নাফরমানি করানোর মাধ্যমে ভালো কাজগুলো নষ্ট করে দিতে চায়। জাহান্নামে আমাদেরকে তার সঙ্গী করতে চায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব, তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ করো। সে তার দলবলকে আহ্বান করে; যেন তোমরা জাহান্নামি হও।’ (সুরা ফাতির : ৬)। শয়তানকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করা তখনই স্বার্থক হবে, যখন আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থেকে সব ধরনের হারাম থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। সুতরাং বরকতময় তারা, যারা ভালো কাজের অনুসরণ করে। মোমিন সর্বদা উত্তম কাজ করে এবং ভালো পরিণতির জন্য দোয়া করে। আফসোস তার জন্য, যে মন্দ কাজের পেছনে ছোটে, যতক্ষণ না তার মৃত্যু আসে। যখন সে কামনা-বাসনার মাঝে থাকে, যেখানে সে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সে যে আনন্দ উপভোগ করেছিল, তা তার কোনো কাজে আসে না, তাই আফসোস চলে যায় এবং বেদনা স্থায়ী হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে রাসুল!) আপনি ভেবে দেখুন, যদি আমি তাদের বছরের পর বছর ভোগবিলাস করতে দিই, অতঃপর যে বিষয়ে তাদেরকে ওয়াদা দেওয়া হতো, তা তাদের কাছে এসে পড়ে, তখন তাদের ভোগবিলাস তাদের কোনো কাজে আসবে?’ (সুরা শুয়ারা : ২০৫-২০৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তাদের ও তাদের বাসনার মধ্যে অন্তরাল হয়ে গেছে, যেমন তাদের সতীর্থদের সঙ্গেও এরূপ করা হয়েছে, যারা তাদের আগে ছিল। তারা ছিল বিভ্রান্তিকর সন্দেহে নিমজ্জিত।’ (সুরা সাবা : ৫৪)। জীবন সাক্ষী দেয়, যারা আল্লাহর আনুগত্য করে, তারাই সুখী। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং আল্লাহর নাফরমানি করে, তারা অসুখী ও দুর্ভাগা।

আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শর্ত

রবের সামনে কেয়ামতের দিন টাকাণ্ডপয়সা, ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কেউ হাজির হব না। বরং আমল নিয়েই উপস্থিত হব। আমল যদি নেক এবং উত্তম হয়, তাহলে মুনকার নাকিরের প্রশ্নোত্তর সহজ হবে। স্থায়ী নেয়ামতের সুসংবাদ দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে আমল যদি নেক না হয়, তাহলে মুনকার নাকিরের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। কঠিন আজাবের সংবাদ দেওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করবে না। তবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, তারা তাদের কর্মের বহুগুণ প্রতিদান পাবে। তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে।’ (সুরা সাবা : ৩৭)। আল্লাহর আনুগত্য আমাদের সঙ্গী। আমাদের কল্যাণ, সৌভাগ্য, বিজয়, সুখ ইত্যাদি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। কিছু বিষয় মেনে চললে ঈমান দৃঢ় হয়। শরিয়তের নির্দেশনা যথাযথ পালন করা সহজ হয়। তা হলো- ১. লোক দেখানো ইবাদত না করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করা, ২. রাসুল (সা.)-এর সুন্নত মোতাবেক আল্লাহর আনুগত্য করা, ৩. সব নাফরমানি থেকে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সপে দেওয়া, ৪. আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো, যে পর্যন্ত তোমাদের কাছে নিশ্চিত মুহূর্ত না আসে।’ (সুরা হিজর : ৯৯)। এ আয়াতে ইয়াকিন শব্দের অর্থ মৃত্যু। পক্ষান্তরে যে এ আয়াতের তাফসিরে বলে, কোনো বান্দা যদি ঈমানের দৃঢ়তায় পৌঁছে যায়, তার ওপর থেকে বোঝা নামিয়ে দেওয়া হয়; অর্থাৎ তার জন্য শরিয়তের কোনো নির্দেশনা আর বাকি থাকে না, তাহলে সে বিদ্রোহী শয়তান, পথভ্রষ্ট। তার কাছে ইসলামের অণু পরিমাণ কদর নেই। যদিও সে সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কাউকে সে রব হিসেবে স্বীকার করে না। এমন কথার কারণে আল্লাহর প্রতি তার একত্ববাদের সাক্ষ্য বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের লোক আল্লাহর বন্ধু নয়, বরং শয়তানের দোসর। আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা তারাই, যারা সালাত আদায় করে, আল্লাহর আনুগত্য করে, কোরবানি করে এবং সর্বদা পরিশুদ্ধ ঈমানের সঙ্গে উত্তম আমল করে।

১৯ শাওয়াল ১৪৪৩ (২০ মে ২০২২) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আল মামুন নূর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত