রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার পিতামাতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষ থেকে প্রিয় হবো।’ (বোখারি-১৫)। ছোট্ট একটা হাদিস, গভীর ভাবার্থ! আজ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নাইবা গেলাম। ‘কেন রাসুলকে ভালোবাসি?’ এই প্রশ্ন যদি নিজেকে নিজে করি। উত্তর খুবই সিম্পল, কেন ভালোবাসব না রাসুল (সা.)-কে?
যদি তাঁর জীবনের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই, সেই ১৫০০ বছর আগে, যখন আমাদের অস্তিত্বই ছিল না! তখন একটা মানুষ রাত জেগে আমাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতেন। আমাদের গোমরাহি হওয়া, ফেতনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ভীষণ শংকিত ছিলেন! তাঁর শুভ্র নুরানি ললাটে ঘোর চিন্তার ভাঁজ আর ঘর্মের মুক্তকণায় ভিজে উঠেছিল। আর বারবার রবকে ডেকে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছেন, হে প্রিয়তম রব, আমার উম্মত! উম্মতি উম্মতি উম্মতি শব্দের ঝংকারে তখন জমিনও কেঁদে উঠত। তোমার কান্নায় সঙ্গ দিতে আকাশ-জমিন, বৃক্ষ-তরু, সাগর-তরঙ্গ, পক্ষীকুল ব্যাকুল হয়ে নীরব এক মাতমে জেগে উঠত ইয়া উম্মতি, উম্মতি, উম্মতি!
তোমায় কেন ভালোবাসব না ইয়া রাসুলুল্লাহ! তুমি শিআবে আবি তালিবে বন্দিত্ব জীবনবরণ করে নিয়েছ, খেয়ে না খেয়ে তখন দিনাতিপাত করেছ। গাছের পাতা পর্যন্ত খেয়েছ। তবু পাহাড়সম দৃঢ়চেতা মন নিয়ে হকের পথে থেকেছ। সবক দিয়ে গেছ কীভাবে হককে আঁকড়ে থাকতে হয়। আর এই নিষ্ঠুরতার শালকায় থেকেও তুমি বলে গেছ, হে রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! আমার উম্মত!
মক্কার কাফেরদের দেওয়া কত গঞ্জনা সহ্য করেছ। আর তায়েফে? আহ! কতই না বিভীষিকাময় ছিল, সৃষ্টি জগতের জন্য সেদিনটি! সরদারে দো আলম দুষ্ট পাষ-দের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। যার জৌলুসে কূল-কায়েনাত আলোকিত সেই নুরানি আভা পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, পদযুগল জুতোর সঙ্গে রক্তে সেঁটে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতেও তুমি ধৈর্যের চরম নজির দেখিয়ে গেছ। তায়েফবাসীর এমন ধৃষ্টতায় আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। তোমার তো বদদোয়ার শব্দ উচ্চারণের দরকারও ছিল না, শুধু মনের মধ্যে যদি তাদের প্রতি একটু বৈরীভাব পোষণ করতে তায়েফের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। তুমি তো দয়ার নবী, ক্ষমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছ। উপরন্তু দোয়ার হাত উত্তোলিত করেছ হুঁশ হারানো পরিস্থিতিতে তায়েফবাসীর জন্য!
তোমার গোটা মক্কা জীবন ঘুরে দেখা যায়- নির্যাতন, জুলুম, হেনস্তা আর দুঃখের উপাখ্যানে মোড়ানো। তথাপি মক্কায় রাজত্ব করার চমকদার সুযোগ পেয়েও তুমি পায়ে ঠেলে দিয়েছ, উম্মাতের বৃহৎ কল্যাণে, নবুয়াতের বৃহৎ দায়িত্ব পালনে, রবের আজ্ঞাবহ হওয়ার জন্য। তুমি কখনও কাউকে ঘৃণা করতে শেখাওনি। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি জোরজবরদস্তি করতে নিষেধ করেছ। তুমি সব ধর্ম, গোত্র, বর্ণের প্রতি উদারনীতি দেখিয়ে গেছ। গ্রোথিত করে গেছ বিশ্ব মানবতার শান্তি শৃঙ্খলার সুবিশাল স্তম্ভ। উড্ডয়ন করে গেছ বিশ্বশান্তির ঝান্ডা। সভ্যতার পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খচিত তোমার সম্মান, আদর্শ ও শ্রেষ্ঠত্ব।
তোমার সৌন্দর্য, গুণ, কণ্ঠ, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র কতটুকুই বা বর্ণনা করা যায়। পনের শতক ধরে যত বর্ণনা হয়েছে, তোমার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। সাহাবারা তোমায় প্রত্যক্ষ দেখেও তোমার সেই নবুয়াতি ব্যক্তিত্ব সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে অপারগতা স্বীকার করেছেন। তুমি সৌন্দর্যের সব স্তর ছাড়িয়ে যাওয়া অনন্য মহামানব। ‘সৌন্দর্য’ তার ‘সৌন্দর্য’ শব্দ পেয়েছে তোমার থেকে কর্জে। সব সৌন্দর্যের স্রষ্টা মহানসত্তা স্বয়ং তোমার সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এরশাদ করেছেন- নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা কলাম : ০৪)।
তোমার নামে পবিত্র কালামুল্লাহর একটা সুরার নামকরণ করা হয়েছে। তোমার সম্মান-ইজ্জত বর্ণনায় নাজিল হয়েছে অসংখ্য আয়াতে কারিমা। এরশাদ হচ্ছে, ‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে-ইমরান : ৩১)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আহযাব : ২১)। অন্য আয়াতে বর্ণিত, ‘রাসুল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (সুরা হাশর : ৭)।
‘হে মোমিনরা, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসুলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসুলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’ (সুরা নিসা : ৫৯)। ‘অতএব, তোমার রবের কসম, তারা মোমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে, সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।’ (সুরা নিসা : ৬৫)।
‘যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হলো, তবে আমি তোমাকে তাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি। (সুরা নিসা : ৮০)। ‘বল, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।’ (আল ইমরান : ৩২)। ‘আর তোমরা সালাত কায়েম কর, জাকাত দাও এবং রাসুলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হতে পার।’ (সুরা নুর : ৫৬)।
তোমায় ভালোবাসি ভালাবাসি বলে কত লম্ফঝম্প করি। মুখে তোমার নামে দুরুদ সালাওয়াত পেশ করি ঠিকই। কিন্তু তোমার ওই আকাশ-ঊর্ধ্ব ইজ্জত, পবিত্রতম নিরেট চরিত্রের বিরুদ্ধে আঙুল চালানো, চোয়াল বাঁকানোর ধৃষ্টতাকারীকে কি-ই বা দিয়েছি জবাব! বুক টান করে হাঁটছে-চলছে তারা। তাদের মতো আমরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। অথচ আজও কাঁদে, গারে হেরা, গারে সাওর, বদর প্রান্তর। চিৎকার করে মাতম করে ওহুদের প্রান্তর। যেখানে আমার রাসুল (সা.) এর দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছে। আকাশ কেঁদেছে, মাটি কেঁদেছে। আজও তারা কাঁদে রাসুলের ইজ্জতে কেউ আঘাত হানলে।
আমি কতটুকু বর্ণনা করব আজ ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার অপারগতা, অক্ষমতা, অধঃপতনের লম্বা ফর্দ থেকে কতটুকু বর্ণনা করব? একদিকে আমার ভালোবাসা, অন্যদিকে আমার অক্ষমতা, অদূরদর্শিতা, কীভাবে দাঁড়াব, তোমার সামনে ইয়া রাসুলুল্লাহ! জীবনের অন্তিমলগ্নে, তুমি নিজ স্ত্রীরা, কন্যাদের, দৌহিত্রদের জন্য কান্না করনি। তখনও তুমি উম্মতি উম্মতি বলে কেঁদেছ। তুমি নিজের জন্য কখন কি-ই বা প্রার্থনা করেছ, গোটা জীবন উম্মাহর কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছ। তুমি সেই নাবী, যিনি হাশরে, মিজানে, বিচারে উম্মতের জন্য দোয়ার শামিয়ানা পেতে সেজদায় শীর নত করে পড়ে রবে।
কতটা ভালোবাসা যায়, তোমায় ইয়া রাসুলুল্লাহ? আমার এতো অপূর্ণতা সত্ত্বেও ইচ্ছেরা ধৃষ্টতা দেখায়। তোমায় দেখে চর্মচক্ষকে শীতল করব। হাউসে কাউসার পান করব তোমার হাতে! আমি কল্পনায় বিভোর হই ভেবে, তুমি আমায় দেখে জান্নাতি সেই মুচকি হাসিটি হাসবে। যে হাসির নুরানি ঝলকে গোটা সৃষ্টিজগৎ স্নাত হতো নুরানি আভায়!
রাসুলুল্লাহ, হাবিবাল্লাহ! হাজারো বিচ্যুতি আমার। কী দেব তোমায়? আমার জানমাল, জীবন জিন্দেগি, পরিবার-পরিজন কোরবান হোক তোমার প্রতি! সালাতু সালাম বর্ষিত হোক তোমার পবিত্র রুহে! ফেদাকা আবি, ওয়া উম্মি ইয়া রাসুলুল্লাহ, ফেদাকা বি হুব্বি ইয়া রাসুলুল্লাহ!
লেখক : শিক্ষার্থী, কামিল (হাদিস বিভাগ), ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর