সুরা আল কাহাফে বেশ অনেকগুলো ঘটনার পরম্পরা আমরা দেখতে পাই। তবে, মুসা আলাইহিস সালামের মতো প্রসিদ্ধ নবী এবং খিজির আলাইহিস সালামের মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তির ঘটনা এই সুরায় থাকলেও, সুরাটা শুরু হয়েছে কিছু যুবকের দ্বীনে অটল-অবিচল থাকবার ঘটনা দিয়েই।
কোন এক সুপ্রাচীন সময়ে, একটা অঞ্চলের সবাই যখন তাওহিদের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ল, যখন তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে হরেক রকমের উপাস্যকে ডাকতে শুরু করল, তখনও কিছু যুবক নিজেদের ঈমান-আমলকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। যখন ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে গোটা জনপদ, তখনও তারা স্রোতে মিশে না গিয়ে, নিজেদের ধরে রাখতে পেরেছিল একত্ববাদের বলয়ে।
কিন্তু, যুবক দলের জন্য ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না। তারা জানত- তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ঘোর বিপদ। তাদের বিশ্বাসের কথা, সঠিক ধর্মে তাদের নিবিষ্ট থাকার ঘটনা যদি জানাজানি হয়ে যায়, যদি তা জনপদের হর্তাকর্তাদের কানে পৌঁছে, তাহলেই তাদের জীবন সংশয়ে পড়ে যাবে। তাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে চিরতরে।
জীবন এবং ঈমান রক্ষার এমন দুর্বোধ্য দোটানায় পড়ে যুবকদল একত্র হলো একটা গুহার মধ্যে। সেখানে তারা আল্লাহর কাছে করজোড়ে দোয়া করল। হৃদয়ের সব আকুতি, সব মিনতি সহকারে তারা আল্লাহকে বলল, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার অবারিত রহমত থেকে আমাদের রহমত দান করুন এবং আমাদের কাজটাকে সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করে দিন।’ (সুরা আল-কাহাফ- ১০)। যে ঘোরতর বিপদের মুখে তারা দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে তাদের বাঁচার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারও নেই। এই দৃঢ় বিশ্বাস তাদের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল বলেই তারা সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় সাহায্য চেয়ে হাত উঠাতে পেরেছিল।
চরম দুঃসময়ে, যখন চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কোনো কিছুই দৃশ্যমান নয়, যখন শত্রুর নিঃশ্বাস একেবারে ঘাঁড়ের ওপরে, যখন দ্বীনের ওপর অটল থাকাটা জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়- এমন অবস্থায়ও এক আল্লাহর ওপর ঈমান ধরে রেখে, দুনিয়ার কারও কাছে ধরনা না দিয়ে, কারও মতের সঙ্গে ‘কম্প্রোমাইজ’ না করে কেবল আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখতে পারাটা নিঃসন্দেহে খুবই উঁচু স্তরের তাওয়াক্কুলের পরিচয় বহন করে। তাওয়াক্কুলের এমন স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিল বলেই আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতায়ালা তাদের দোয়া কবুল করেছিলেন। তাদের দয়া করেছিলেন এবং হেফাজত করেছিলেন তাদের ঈমান।
তিনি তাদের এক সুদীর্ঘকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেন। যখন তাদের ঘুম ভাঙলো, তারা অবাক বিস্ময়ে জানতে পারে- যে অত্যাচারী সম্প্রদায়ের হাত থেকে বাঁচতে তারা একদা গুহায় ঢুকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল, সেই অত্যাচারী সম্প্রদায় বহু আগেই গত হয়েছে! দুনিয়ায় আর তাদের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই! ঈমান থেকে বিচ্যুত না হওয়ায় একদা যেভাবে তাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সেই দুঃসময় এক ঝটিকা স্বপ্নের ভেতরেই অন্তর্হিত হয়েছে।
এই যুবক দলের ঘটনা কেনই-বা সুরা কাহাফে আসবে, তাণ্ডও আবার একেবারে শুরুতে? কেন প্রতি জুমাবারে সুরা কাহাফ তেলাওয়াতের জন্য নবীজি (সা.) ভীষণভাবে জোর দিয়েছেন? কারণ, যুবক দল এখনও আমাদের জীবনে ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক। দ্বীন পালন করতে গিয়ে এখনও আমরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হই। চারপাশের এত এত বক্রতা, এতো বিদ্বেষ, এত ভুল আর ভ্রান্তির ভেতর মাঝে মাঝে আমরা সত্যিই হাঁপিয়ে উঠি। মনে হয়, এই বুঝি হাল ছেড়ে দিতে হবে! এই বুঝি আর পারলাম না!
দ্বীন পালনে এমন বিভিন্ন বাধা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে ঘুরেফিরেই আসে। কিন্তু, যদি আমরা আসহাবে কাহাফের সেই যুবকদের মতো একটা গুহা খুঁজে নিতে পারি, যে গুহায় আমরা কাকুতি-মিনতি করে কেবল আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইব, যে গুহায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আল্লাহর সমীপে নিজের সব অপারগতা, অক্ষমতা পেশ করে সব চাওয়া চাইব।
ভাবছেন, দ্বীনে অটল-অবিচল থাকার তাগিদে, আল্লাহর কাছে এভাবে চাইতে হলে কোন গুহায় গিয়ে ঠাঁই নেবেন, তাই তো? আমি খোঁজ দিচ্ছি। আপনার ঘরের কোণে, যে নিভৃত জায়গাটা আছে, মাঝরাতে সেখানটায় জায়নামাজটা পাতুন, এরপর দাঁড়িয়ে যান আল্লাহর সামনে। খুলে বলুন আপনার মনের সব বাসনা, সকল দুঃখণ্ডকষ্ট, যা আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আপনার সব অপ্রাপ্তি, সব মন খারাপের গল্প তাঁর সঙ্গেই করে ফেলুন। দেখবেন, আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদের মতো তিনি ঠিক-ই আপনার জন্য একটা রাস্তা বের করে দেবেন, যাতে করে আপনি আপনার সমস্যাকে সবরের সঙ্গে উতরে যেতে পারবেন। ভেঙে পড়বেন না। কেবল আপনার গুহাটা খুঁজে নিন।