ঢাকা রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নবী আদর্শের সাহাবা চরিত

মুহাম্মদ আবু আহনাফ
নবী আদর্শের সাহাবা চরিত

‘এই যুবক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে, আমরা এর বিচার চাই।’ দোষী যুবককে টেনে-হিঁচড়ে খলিফার দরবারে নিয়ে এসেছেন দুই ব্যক্তি। তারা তাদের পিতা হত্যার বিচার চান। খলিফা হজরত উমর (রা.) সেই যুবককে জিজ্ঞেস করলেন যে, তার বিপক্ষে করা অভিযোগ সত্য কি-না। অভিযোগ স্বীকার করল যুবক। দোষী যুবক সেই ঘটনার বর্ণনা দিল:

‘অনেক পরিশ্রমের কাজ করে আমি বিশ্রামের জন্য একটি খেজুর গাছের ছায়ায় বসলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্প সময়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র বাহন উটটি পাশে নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছুদূর গিয়ে পেলাম, তবে তা ছিল মৃত। অভিযোগকারী এই দুই ব্যক্তির বাবাকে আমার মৃত উটের পাশে পেলাম। সে আমার উটকে তার বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছে। এই কারণে আমি হঠাৎ করে রাগান্বিত হয়ে পড়ি এবং তার সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি। ফলে সে সেইখানেই মারা যায়। যা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘটে গেছে। এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

বাদীরা জানালেন- ‘আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই।’ সব শুনে হজরত উমর (রা.) অপরাধী যুবককে বললেন, ‘উট হত্যার বদলে তুমি একটা উট দাবি করতে পারতে; কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছ। হত্যার বদলে হত্যা। এখন তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তোমার কোনো শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পার।’ নওজোয়ান বলল, ‘আমার কাছে কিছু ঋণ ও অন্যের রাখা কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছু দিন সময় দিতেন, আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋণগুলো পরিশোধ করে আসতাম।’

খলিফা হজরত উমর (রা.) বললেন, ‘তোমাকে এভাবে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকে জিম্মাদার রেখে যেতে পার তবে তোমায় সাময়িক সময়ের জন্য যেতে দিতে পারি।’ নওজোয়ান বলল, ‘এখানে আমার কেউ নেই যে, আমার জিম্মাদার হবে।’ যুবকটি তখন নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এ সময় হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত একজন সাহাবি হজরত আবু যর গিফারি (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি হবো ওই ব্যক্তির জামিনদার। তাকে যেতে দিন।’ আবু যর গিফারির (রা.) এই উত্তরে সভায় উপস্থিত সবাই হতবাক। একে তো অপরিচিত ব্যক্তি, তার ওপর হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি! তার জামিনদার কেন হচ্ছেন আবু যর!

খলিফা বললেন, ‘আগামী শুক্রবার জুমা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেওয়া হলো। জুমার আগে নওজোয়ান মদিনায় ফেরত না এলে নওজোয়ানের বদলে আবু যরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’ মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটল মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবু যর গিফারি (রা.) চলে গেলেন নিজ বাড়িতে।

দেখতে দেখতে জুমাবার এসে গেল। নওজোয়ানের আসার কোনো খবর নেই। হজরত উমর (রা.) রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবু যর গিফারির (রা.) কাছে। পত্রে লেখা, আজ শুক্রবার বাদ জুমা সেই যুবক যদি না আসে, আইন মোতাবেক আবু যর গিফারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। আবু যর যেন সময় মত জুমার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববিতে হাজির হন। খবর শুনে সারা মদিনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবি আবু যর গিফারি আজ বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববির সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। কারণ দণ্ডপ্রাপ্ত যুবক এখনও ফিরে আসেনি। জল্লাদ প্রস্তুত। জীবনে কতজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছে না জল্লাদ। আবু যরের মতো একজন সাহাবি সম্পূর্ণ বিনাদোষে আজ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, এটা মদিনার কেউ মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর (রা) নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। হৃদয় তার ভারাক্রান্ত। তবু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারও পরিবর্তনের হাত নেই। আবু যর (রা.) তখনও নিশ্চিন্ত মনে হাঁসি মুখে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবু যর (রা.) এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।

এমন সময় এক সাহাবি উচ্চ স্বরে জল্লাদকে বলে উঠলেন, ‘হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভূমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ওই দেখ কে যেন আসছে। হতে পারে ওইটা নওজোয়ানের ঘোড়ার পদধূলি। একটু দেখে নাও।’ ঘোড়াটি কাছে এলে দেখা যায় সত্যিই এ সেই নওজোয়ান।

নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বলল, ‘আমিরুল মুমিনিন, মাফ করবেন। রাস্তায় যদি আমার ঘোড়া পায়ে ব্যথা না পেত, তবে যথাসময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে গিয়ে আমি একটুও দেরি করিনি। বাড়ি পৌঁছে গচ্ছিত আমানত ও ঋণ পরিশোধ করি। তারপর বাবা, মা এবং নববধূর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদিনার উদ্দেশে রওনা দিই। এখন আমার জামিনদার ভাইকে ছেড়ে দিন আর আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেননা, কেয়ামতের দিন আমি খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না।’

আশপাশের সবাই একেবারেই নীরব। চারদিকে একদম থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কী হতে চলেছে! যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিল সবাইকে।

খলিফা হজরত উমর (রা.) যুবককে বললেন, ‘তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, তারপরও কেন ফিরে এলে?’ উত্তরে সেই যুবক বলল- ‘আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলামান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গিয়েছিল।’

এবার হযরত উমর (রা.) হজরত আবু যর গিফারি (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন না চেনা সত্ত্বেও এর জামিনদার হলেন?’ উত্তরে হজরত আবু যর গিফারি (রা.) বললেন, ‘পরবর্তী সময়ে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিল, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।’ এমন কথা শুনে, হঠাৎ বৃদ্ধের দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠল, ‘হে খলিফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার ওপর করা অভিযোগ তুলে নিলাম।’

হজরত উমর (রা.) বললেন, ‘কেন তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছ?’ তাদের এক ভাই বলে উঠল, ‘কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান অনাকাক্সিক্ষত ভুল করে নিজেই স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি।’

সূত্র : হায়াতুস সাহাবা : ৮৪৪

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত