ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আরাফা দিবসের ফজিলত

মুফতি মুহাম্মদ আনিসুর রহমান রিজভি
আরাফা দিবসের ফজিলত

মাস, দিন, সময়- এগুলোর সূচনা পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু হয়েছে। জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ফজিলত অন্য যে কোনো মাসের যে কোনো দিনের চেয়েও বেশি। এ ১০ দিনের মধ্যে ৯ জিলহজ ইয়াওমে আরাফা। এ দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা আরাফার ময়দানে সমবেত হ। এ দিনের ফজিলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনকে মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত প্রাপ্তি এবং গোনাহ থেকে পরিত্রাণের দিন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

আরাফা দিবসের পরিচয়

আরাফা শব্দের অর্থ হলো পরিচিতি, হজরত দ্বাহহাক (রহ.) বলেন, হজরত আদম (আ.)-কে হিন্দুস্তানে এবং হাওয়া (আ.)-কে জেদ্দায় বেহেশত থেকে অবতরণ করা হয়েছিল। অবতরণের পর তারা পরস্পর পরস্পরকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একদিন উভয়ে আরাফাতের ময়দানে আরাফার দিনে মিলিত হলেন এবং একে অপরের মধ্যে পরিচয় ঘটল। এ কারণে ওই স্থানের নাম হলো আরাফাত, আর ওই দিনের নাম হলো আরাফার দিন।

আরাফা দিবসের ফজিলত

আরাফার দিনের ফজিলত সম্পর্কে বোখারি শরিফে বর্ণিত আছে, ইহুদিরা হজরত ওমর (রা.)-কে বলল, আপনারা এমন একটি আয়াত পড়ে থাকেন তা যদি আমাদের ওপর নাজিল হতো, তবে আমরা সেটাকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতাম। হজরত ওমর (রা.) বললেন, এটা কখন এবং কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে আর নাজিলের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) কোথায় ছিলেন তা আমি জানি। আল্লাহর শপথ! আমরা সবাই এ সময় আরাফাতে ছিলাম। এ দিন আমাদের জন্য দুটি ঈদ ছিল, প্রথমত, সেদিন ছিল জুমাবার, যাকে আমরা ঈদ হিসেবে উদযাপন করি, দ্বিতীয়ত, সে দিন ছিল ইয়াওমে আরাফা, যাকে হাদিসে ঈদের দিন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। (বোখারি : ৪২৫১)।

জুমার দিন ও আরাফার দিন ঈদের দিন

জুমার দিন ও আরাফার দিন ঈদের দিন। কেননা, হাদিসের মধ্যে এ দুই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হজরত ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ আয়াত আরাফাতের ময়দানে জুমার দিন নাজিল হয়েছিল। আল্লাহর শোকর যে, এ উভয় দিন (জুমা ও আরাফা) আমাদের জন্য ঈদের দিন। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলমানও পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন এ দুটি দিন মুসলমানের জন্য ঈদের দিন হিসেবে গণ্য থাকবে। একটি হলো জুমার দিন, আরেকটি হলো ইয়াওমে আরাফা তথা আরাফার দিন। (আবু দাউদ : ২৪১৯)।

আরাফা দিবসে দ্বীন পূর্ণতার ঘোষণা

আরাফার দিনে আরাফাতের ময়দানে নবীজি (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম যখন উকুফে আরাফা করছিলেন, তখনই আল্লাহতায়ালা নবীজি (সা.)-এর ওপর কোরআনুল কারিমের সর্বশেষ আয়াত নাজিল করে দ্বীনকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আর সেটি হলো সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াত। এই আয়াত নাজিল করে আল্লাহতায়ালা বলেন, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য চূড়ান্ত দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। এ আয়াত নাজিলের পর নবীজি (সা.) মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ২/২৪২)।

আরাফার দিন সর্বোত্তম দিন

হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, আরাফা দিবসের চেয়ে উত্তম কোনো দিন নেই। এই দিনে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীবাসীকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, তোমরা আমার ওইসব বান্দাদেরকে দেখ, যারা বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো চুল নিয়ে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আমার রহমতের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে আমার কাছে এসেছে। সুতরাং আরাফা দিবসের চেয়ে বেশি দোজখ থেকে মুক্তির আর কোনো দিন নেই। এই দিনে যে পরিমাণ লোক দোজখ থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে, অন্য কোনো দিন করবে না। (ইবনে হিব্বান : ৩৮৫৩)।

আরাফা দিবস গোনাহ মাফের দিন

হজরত নাফে (রা.) হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা আরাফার দিন স্বীয় বান্দার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান থাকবে, তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। হজরত নাফে (রা.) বলেন, আমি ইবনে ওমর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এই ক্ষমা কি সব ঈমানদারের জন্য নাকি শুধু আরাফাবাসীর জন্য খাস? উত্তরে তিনি বলেন, এই ক্ষমা সব ঈমানদারের জন্য। (ইবনে রজব হাম্বলী (র.), লাতায়েফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৪৭১)।

আরাফার দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিন

আরাফার দিনে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, আরাফা দিবসের চেয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য অন্য কোনো দিন নেই। (ইবনে খুজাইমা : ৪/৪৪২)। মুসলিম শরিফে আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, আরাফা দিবসে রোজা রাখলে আশা করি আল্লাহতায়ালা রোজাদারের এক বছরের আগের ও এক বছরের পরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম : ১১৬২)।

আরাফার দিনে হাজীদের রোজা রাখা মাকরুহ

বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা.) আরাফা দিবসে হাজীদের আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। (হুলিয়াতুল আউলিয়া: ৩/৩৯৭)। অনেকেই হাজী সাহেবানদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা মাকরুহ বলেছেন। কারণ এই দিন তাদের অধিক হারে জিকির, দোয়া ও মোনাজাতে লিপ্ত থাকতে হয় এবং অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। রোজার কারণে যাতে তারা দুর্বল হয়ে না যায়, সে কারণে হাজীদের সে? দিন রোজা রাখা থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছেন। তবে যারা সামর্থ্যবান তথা রোজার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না, তাদের জন্য রোজা রাখাই উত্তম।

সমাপনী

আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ফরজ। আরাফাতের ময়দানে হাজীরা হাজির হয়ে আল্লাহর রহমত তালাশ করে। সমবেত সবাই এবাদত-বন্দেগি ও গোনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করে আল্লাহর জিকির, দোয়া, মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে। আর আল্লাহতায়ালাও বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগি এবং কান্নাকাটির বিনিময় হিসেবে তাদের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের ঘোষণা দেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের জীবনে অন্তত একবার হলেও আরাফাতের ময়দানে হাজির হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহকারী মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভিয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম এবং এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত