কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয় মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা। কোরবানি নতুন কোনো প্রথা নয়, বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হজরত আদম (আ.) এর যুগে কোরবানির সূচনা হয়েছিল। আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহশাদি নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাদের ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার কাছে কবুল হবে, তার কাছে মেয়ে বিবাহ দেওয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল। হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হলো, কাবিলের হলো না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- ‘হে নবী আপনি তাদের কাছে যথাযথভাবে আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের কাছে তাদের কোরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হলো অন্যজনের হলো না। যার কোরবানি কবুল হলো না, সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল, আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলব। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা : ২৭)।
কোরবানির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কোরআন কারিমে এরশাদ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার কাছে পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। কোরআনে আল্লাহ আরও বলেন- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। (সুরা হজ : ৩৪)। আল্লাহতায়ালা কোরআনে আরও বলেছেন- ‘নিশ্চই আমার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার কাছে পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)।
একদা হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসুলের (সা.) কাছে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরবানি কী? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করলেন- কোরবানি হচ্ছে, তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনাদর্শ। সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কোরবানির ফজিলত কী? রাসুল (সা.) বললেন, পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেওয়া হয়।’ (মেশকাত : ১২৯)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সব গোনাহ মোচন করে দেওয়া হয়।’ (তিরমিজি ; ১/১৮০)। মহানবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটাতাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে।’ (মুসলিম : ২৬৩৯)। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় ১০ বছর জীবনযাপন করেছেন, প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি : ১/১৮৯)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই।’ (মেশকাত : ১৯৩৭)। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করে না, সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়। (ইবনে মাজাহ : ১৭২১)।
ইসলামে যেহেতু কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। তাই কোরবানি সম্পর্কিত মাসআলা-মাসায়েল জেনে বিশুদ্ধভাবে কোরবানি করা জরুরি। অন্যান্য ইবাদতের মতো কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে বেশ কিছু নিয়ম ও বিধিবিধান। নিম্নে কোরবানির প্রয়োজনীয় কিছু মাসআলা নিয়ে আলোকপাত করা করা হলো।
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব
ঈদুল আজহার দিন প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ যার কাছে থাকবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ ১ বছর থাকা জরুরি নয়, কোরবানির শেষ দিন সূর্যাস্তের আগেও কেউ যদি নেসাব পরিমাণের মালিক হয়, তাহলে তার ওপরও কোরবানি ওয়াজিব। জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পরিমাণ জমি ও ফসলের দরকার তা থেকে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য অথবা যে কোনো একটির মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। একই পরিবারের সব সদস্য পৃথক পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হলে সবার ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব। কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করলে সে উদ্দেশে পূর্ণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। অতএব, প্রত্যেক স্বাধীন, ধনী, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব।
কোরবানির পশু ও তার বয়স
ইসলামি শরিয়তে গরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, উট কোরবানি করাকে বৈধতা দান করেছে। তবে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করা চলবে; কিন্তু গরু, মহিষ, উট সাত ব্যক্তি শরিক হতে পারবে। শর্ত একটাই শরিকদার সবার নিয়ত বিশুদ্ধ থাকতে হবে। এদের মধ্যে একজনেরও যদি লোক দেখানো বা গোশত খাওয়া উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কারও কোরবানি কবুল হবে না। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এক বছর বয়সি হওয়া আবশ্যক। তবে যদি ৬ মাসের দুম্বা এবং ভেড়া এরূপ মোটাতাজা হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়, তাহলে ওই ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা যাবে। আর ছাগল যত বড়ই হোক না কেন, ১ বছর পরিপূর্ণ হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি জায়েজ হবে না। গাভি, মহিষ দু’বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। উট ৫ বছরের হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি হবে না। কোরবানির জন্য মোটা, তরতাজা, সুস্থ পশু হওয়া জরুরি। আতুড়, লেংড়া, কানা, কানকাটা, লেজকাটা, দুর্বল পশু দিয়ে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না।
কোরবানির দিন
কোরবানির দিন হলো- ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ। এ ৩ দিনের মধ্যে যেকোনো দিন কোরবানি করা জায়েজ আছে। তবে উত্তম দিন হচ্ছে- প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ। কোনো কারণ ছাড়া বিলম্ব না করা ভালো।
কোরবানির সময়
জিলহজের দশম দিন ঈদের নামাজ পড়ার পর থেকে জিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কোরবানি করা যাবে। তবে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা যাবে না। ঈদের নামাজ পড়ে এসে কোরবানি করতে হবে। যদি শহরের একাধিক স্থানে ঈদের নামাজ হয়, তাহলে যেকোনো এক স্থানে নামাজ আদায় হয়ে গেলে সব স্থানেই কোরবানি করা জায়েজ হবে।
জবেহ
কোরবানি দাতা সে নিজেও জবেহ করতে পারবে এবং কোনো আলেমকে দিয়ে কোরবানি করাতে পারবে। তবে উত্তম হচ্ছে নিজের কোরবানি নিজে করা। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরি নয় বরং অন্তরের নিয়তই যথেষ্ট। জবেহ করার সময় অবশ্য অল্লাহর নাম নিতে হবে।
কোরবানির গোশত
কোরবানির গোশত নিজে খাবে এবং গরিব-মিসকিনদের খওয়াাবে। উত্তম পন্থা হচ্ছে- গোশতকে তিনভাগে ভাগ করা, একভাগ গরিব-মিসকিনকে দান করা, একভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া এবং এক অংশ নিজ পরিবারের জন্য রাখা। তবে তিনভাগ করা জরুরি নয়, নিজের পরিবারের লোক সংখ্যা বেশি হলে নিজেরা খাবে, আত্মীয়স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের খাওয়াবে।
পশুর চামড়া
কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবেন এবং অন্যকে হাদিয়াও দিতে পারবেন। আবার মাদ্রাসার লিল্লাহ ফান্ডেও দান করা যাবে। কিন্তু কোরবানির চামড়া বিক্রি করে কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামের ভাতা দেওয়া যাবে না। বিক্রি করলে চামড়ার টাকা একমাত্র গরিব-মিসকিনকেই দান করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে মাদ্রাসার গরিব ফান্ডে দান করা।
(তথ্য সূত্র : আহসানুল ফাতাওয় ৭/৫১০, তিরমিজি ১/১২০, ইমদাদুল ফাতায়া ২/১৬৬, মুয়াত্তা মালেক ১৮৮)
লেখক : মুহতামিম, ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার