ঢাকা শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নিরক্ষরতা ও কুশিক্ষার প্রতি নবীজির ভীতি প্রদর্শন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
নিরক্ষরতা ও কুশিক্ষার প্রতি নবীজির ভীতি প্রদর্শন

খুবই স্বল্প সময়ে রাসুল (সা.)-এর হাতে এক বিপুল সংখ্যক লোক সুশিক্ষিত হয়ে সর্বোচ্চ উন্নতির শীর্ষে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সুসভ্য জাতির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। রাসুল (সা.) তাদের দলে দলে এবং সম্মিলিতভাবে দ্বীনের শিক্ষা দান করেন। অজ্ঞতা দূরীকরণে তাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেন। এর পাশাপাশি তাদের সব ধরনের কুশিক্ষা থেকে নিরাপদ এবং সদা সতর্ক থাকার ওপর বিশেষ তাগিদ দেন। রাসুল (সা.)-এর সে সুশিক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে ইতিহাস নিন্দিত আরবের বর্বর ও অজ্ঞ জাতি, যারা জাহেলিয়াতের অতল গহ্বরে তলিয়েছিল, পঠন-পাঠন এবং দ্বীনের গভীর প্রজ্ঞা অর্জন করতে বিপুল উদ্দীপনা ও স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে আলেম ও বিজ্ঞজনদের চারপাশে এসে ভিড় জমাতে থাকে। ফলে অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের কপোল-আকাশ থেকে অজ্ঞতার জমাটবাঁধা মেঘ অপসারিত হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুনাজিরি (রহ.) আত তারগিব ওয়াত তারহিব এবং আল্লামা হায়সামি (রহ.) মাজমাউজ জাওয়ায়েদ গ্রন্থে একটি দীর্ঘ হাদিস উল্লেখ করেছেন। আলকামা (রা.) তার পিতা সাদি (রা.) থেকে, তিনি তার পিতা সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আবি (রা.) থেকে বর্ণনা করেন; একদিন রাসুল (সা.) খুতবা দিতে গিয়ে সর্বপ্রথম আল্লাহতায়ালার গুণকীর্তন করেন। এরপর একটি গোত্রের বিভিন্ন ভাষায় প্রশংসা করে আরেক গোত্রের সম্বন্ধে বলেন, ‘ওইসব লোকের কী হলো, যারা স্বীয় প্রতিবেশীদের দ্বীনের গভীর জ্ঞান ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে না? তাদের সৎকর্মের প্রতি অনুপ্রাণিত করে না? অন্যায়-অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত রাখে না?’ অর্থাৎ তারা এমনটি করে না কেন যে, প্রতিবেশীদের অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখলে তাদের তা হতে বিরত হওয়ার আহ্বান জানাবে এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলতে তাদের অনুরোধ জানাবে? এরপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘এই প্রতিবেশীরাও কেন তাদের আলেম ও জ্ঞানীদের থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করে না? আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, প্রত্যেক গোত্রের জ্ঞানী লোকদের কর্তব্য হলো, প্রতিবেশী-অজ্ঞদের দ্বীনি শিক্ষা প্রদান করা। অনুরূপভাবে প্রতিবেশীদেরও উচিত, তাদের আলেমদের কাছে গিয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা। নইলে অনতিবিলম্বে দুনিয়াতেই তারা এর পরিণতি ভোগ করবে।’

এরপর রাসুল (সা.) মিম্বার থেকে অবতরণ করে নিজ এলেন। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম এ প্রশ্নে আলোচনামুখর হয়ে উঠল, রাসুল (সা.) অনির্দিষ্টভাবে যে লোকদের আলোচনা করে গেলেন, তারা কারা হতে পারে? কিছু লোক মন্তব্য করেন, যতদূর অনুমান করা যায়, তাতে মনে হয়, আশআরিদের ব্যাপারেই রাসুল (সা.) এ কথাগুলো বলেছেন। কারণ, তারা নিজেরা খুব জ্ঞানী আর তাদের প্রতিবেশীরা শ্রমজীবী ও যাযাবর। আশআরিদের কানে এ খবর পৌঁছাল। তারা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি একদল লোকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আর আমাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সে হিসেবে আমরা জানতে চাচ্ছি, আমাদের অপরাধ কোথায়?’ জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘প্রতিবেশীদের দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া প্রত্যেক জ্ঞানী গোত্রের কর্তব্য। অনুরূপ প্রতিবেশীদেরও আলেমদের কাছে গিয়ে দ্বীনি জ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন করা চাই। নইলে সেদিন দূরে নয়, যেদিন তারা আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে।’

এ কথা শুনে তারা নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তবে কি আমাদের অন্যদের থেকে ইলম অর্জন করতে বলেন?’ উত্তরে রাসুল (সা.) আগের কথাটির পুনরাবৃত্তি করেন। দ্বিতীয় দফায় এভাবেই প্রশ্ন ও তার প্রত্যুত্তর চলল। এরপর আশআরিরা সময় চেয়ে আবেদন করে বলল, ‘আমাদের একটি বছর সুযোগ দিন।’ রাসুল (সা.) তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের এক বছরের সময় দেন। যাতে এ সময়ের মাঝে তারা প্রতিবেশীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার কর্মসূচি সফল করে তুলতে পারে। অতঃপর রাসুল (সা.) এ আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘বনি ইসরাইলের যারা কাফের ছিল, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের ভাষায় লানত করা হয়েছিল। কারণ, তারা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতা করে সীমালঙ্ঘন করেছিল। যে অন্যায় তাদের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা হতে পরস্পরকে বিরত রাখত না। বাস্তবিকই তাদের কৃতকর্ম মন্দ ছিল।’ (সুরা মায়িদা : ৭৮)।

হাদিসে শিক্ষিতদের প্রতি অশিক্ষিতদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা, শিক্ষিত সমাজের প্রতি প্রতিবেশীদের এই হক পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও দ্বীনি সুসম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদাচরণ ও উত্তম ব্যবহার ইসলামের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, যা মানুষকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উপযুক্ত করে দেয়। এ কারণেই আপন সন্তান এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারীদের মতো প্রতিবেশীদের ব্যাপারেও সম্পদের ওয়ারিশ হওয়ার ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এক হাদিসে রাসুল (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে ঘন ঘন প্রতিবেশীদের হক সম্পর্কে সচেতন ও অসিয়ত করেন। তার উপর্যুপরি অসিয়তে এক পর্যায়ে আমার আশঙ্কা জাগে, হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বলে দেবেন।’ এক প্রতিবেশীর প্রতি অপর প্রতিবেশীর নৈতিক ও ধর্মীয় কর্তব্য হলো, তাকে দ্বীনি জ্ঞানে শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ করে তোলা। কেননা, ইলম বা দ্বীনি জ্ঞান সবচেয়ে দামি ও উপকারী বস্তু। বস্তুত এ কারণেই ইলমের দীক্ষাকে প্রতিবেশীর অন্যতম হক বা প্রাপ্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আল্লামা মুস্তফা জারকা (রহ.) আল মাদখালুল ফিকহিয়্যিল আম গ্রন্থে এ হাদিসটি উল্লেখ করে এর টীকায় লেখেন, ‘যদি কোনো আলেম দ্বীনের শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে এবং রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত নীতি অনুসরণ করতে ত্রুটি করে অথবা অজ্ঞ-মূর্খ যদি সীমিত পর্যায়ে দ্বীনি জরুরি জ্ঞান অর্জন করতে ত্রুটি কিংবা অনীহা প্রদর্শন করে, তবে উভয়ে নিজ নিজ ক্রটির অপরাধে শাস্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।’

এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)। এ হাদিসে মুসলমান বলতে পুরুষ-নারী উভয় উদ্দেশ্য। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ইলম অর্জন ফরজ করার মধ্যে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, যারা ইসলামের জন্য নিবেদিত এবং ইসলাম অনুযায়ী চলতে চায়, ইলম অর্জন করা তাদের জন্য অপরিহার্য। ইসলামে ইলম অর্জন ও জ্ঞানচর্চার গুরুত্বের বিষয়টি স্পষ্ট। রাসুল (সা.)-এর প্রতি সর্বপ্রথম যে আয়াত অবতীর্ণ হয়, তাতে ইলম অর্জনের প্রতি জোর গুরুত্বারোপ করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনার রবের নামে পড়ুন। যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন; যিনি মানুষকে জমাট রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। আর আপনার রব বড়ই দয়াময়। তিনি কলমের সাহায্যে শিখিয়েছেন এবং মানুষকে আরও শিক্ষা দিয়েছেন (অন্যান্য মাধ্যমে) ওইসব বস্তু, যা তারা জানত না।’ (সুরা আলাক : ১-৫)।

রাসুল (সা.)-এর অনুপম চরিত্র ও উন্নত শিক্ষার বিবরণ

নিরক্ষর ও জাগতিক কোনো প্রক্রিয়ায় জ্ঞান অর্জন না করা সত্ত্বেও আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে এমন প্রভূত জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছিলেন, তার মতো জগদ্বিখ্যাত গুরু, বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয় আর কেউ ভূমিষ্ঠ হয়নি, আর হবেও না। আল্লাহতায়ালা তাকে অফুরন্ত ও অগাধ নেয়ামত দান করেছিলেন। তিনি তাকে সর্বদিক দিয়ে নজিরবিহীন, অনন্য এবং একজন পরিপূর্ণ ও সফল মানবরূপে প্রেরণ করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর প্রতি আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত অনুগ্রহের আংশিক নমুনা এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে, ‘হে নবী! তিনি আপনাকে ওইসব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না। আর আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ সীমাহীন ও বিশাল।’ (সুরা নিসা : ১১৩)।

রাসুল (সা.) আল্লাহতায়ালার নির্দেশক্রমে এক প্রকার খালি হাতেই ময়দানে নেমে পড়েন। একত্ববাদের ডালি ও পসরা সাজিয়ে মক্কার অলিগলি ও রাস্তাঘাটে দ্বীনের প্রচার-প্রসার করতে থাকেন। ঝরঝরে উচ্চ সাহিত্যপূর্ণ ভাষা, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, প্রয়োজনে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা, প্রশস্ত বক্ষ, নরম হৃদয়, রহমণ্ডদয়া, উদারচিত্ত, সুকৌশলী, রাগ-ক্রোধ, তীক্ষ¥ মেধা, গভীর বিচক্ষণতা এবং মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের সুবাদে সমগ্র বিশ্বের অদ্বিতীয় শিক্ষকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি নিজেও বলেন, ‘জগতে আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৯)।

উপকারহীন জ্ঞান অর্জন করা থেকে পরিত্রাণের শিক্ষা

রাসুল (সা.) অনোপকারী ইলম থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিয়েছেন। মানুষকে এ বিষয়ে উপদেশ দিতে দিতে এক পর্যায়ে এটা তার নিজের দোয়াতেই পরিণত হয়েছিল। অধিকাংশ সময় তাকে এ দোয়া করতে শোনা যেত, ‘হে আল্লাহ! অনোপকারী ইলম, নির্ভীক অন্তর, অতৃপ্ত আত্মা এবং ব্যর্থ দোয়া হতে আমি আপনার আশ্রয় চাচ্ছি।’ রাসুল (সা.) কথা ও কাজ সবদিক দিয়ে একজন মহান ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন। যার ফলে এ দোয়ায় তার পক্ষ থেকে শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের প্রতি এ শিক্ষা রয়েছে যে, যেসব বিষয় শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিত্যাজ্য ও অগ্রহণযোগ্য, তা থেকে সর্বদা দূরে থাকতে হবে এবং ক্ষতিকর বলে ভয় করে এড়িয়ে চলতে হবে।

দোয়ায় ওই ইলম থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে, যা ইলম অর্জনকারীর জন্য যে কোনোভাবে ক্ষতিকর এবং অনিষ্টকর হতে পারে। এটা স্বীকৃত সত্য যে, অনিষ্টের মাধ্যমেও অনিষ্ট হয়। ফলে অন্যায় ও শরিয়তবিরোধী পন্থায় ইলম অর্জন করা অথবা ইলমের মাধ্যমে অন্যায়-অনৈতিকতা ছড়ানো নিজের মূল্যবান সময় অনর্থক বিষয় অর্জনে নষ্ট করার মতো। এমন নিন্দনীয় ইলম থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেই হয়। এমনিভাবে চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি পন্থায় অর্থ-সম্পদ কামাই করে তা দিয়ে ইলম অর্জন করাটাও অনোপকারী এবং অন্যায়ের পথ সুগমকারী হয়। এ জাতীয় ইলম থেকে অজ্ঞতাণ্ডমূর্খতা অনেক ভালো। এ ক্ষতিকর ইলম তেমন, যেমন নবজাতকের জন্য বিভিন্ন রকমের মিষ্টান্ন এবং পাখির সুস্বাদু গোশত। মাঝেমধ্যে আলেম ব্যক্তি হতে এমন অযাচিত ভুল প্রকাশ পায়, যা তার থেকে প্রকাশ পাওয়া কাম্য ছিল না। বস্তুত এ সময় ওই কথার বাস্তবতা মূর্ত হয়ে সামনে আসে যে, এমন ইলম থেকে মূর্খতাই উত্তম। বর্তমানে মানুষ ব্যাপকহারে ওই জ্ঞান অর্জনে নিজের অর্ধ-জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, যার জ্ঞান অর্জন করা তার জন্য ততটা জরুরি ছিল না। এর পরিণতি পরিশেষে এই দাঁড়ায় যে, এমন ইলম বা জ্ঞান তার দুনিয়া-আখেরাত উভয়ই ধ্বংস ও বরবাদের কারণ হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত