আবেগ ও বিনয়ে কান্না
কিছু কিছু সময় নবীজি (সা.)-এর মাঝে বিশেষ আবেগ ও বিনয় কাজ করত। তার মধ্যে অন্যতম হলো, হাজরে আসওয়াদ। নবীজি (সা.) একবার হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন। ফিরে এসে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তখন কান্নায় তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। (সুনানে বায়হাকি : ৭২৩৪)। এ ছাড়া যখন আবু তালেব কাফেরদের পীড়াপীড়িতে নবীজি (সা.)-কে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বললেন, তখনও তিনি চাচা আবু তালেবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কেঁদে ফেলেছিলেন। (সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৩৬৭৫)।
ইবাদতে কান্না
নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত বা অন্য কোনো ইবাদতে নবীজি (সা.) খুব কাঁদতেন। তার চোখ থেকে দরদর করে অশ্রু ঝরত। নবীজি (সা.)-এর কান্নার ধরন প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর কান্না ছিল তার হাসির মতোই নীরব। তিনি শব্দ করে কাঁদতেন না, যেমন স্বশব্দে হাসতেন না। শুধু তার দুই চোখ অশ্রু ঝরাত।’ (যাদুল মায়াদ : ১৮৩)।
নামাজে কান্না
নামাজে দাঁড়িয়ে (বিশেষত রাতের নফল নামাজে) নবীজি (সা.) খুব কাঁদতেন। কখনও সাহাবিরা জানতে পারতেন, কখনও বুঝতেও পারতেন না, নবীজি (সা.) কাঁদছেন। তার দুই চোখ ছাপিয়ে শুধু অশ্রু ঝরত। আবার কখনও নামাজে কোরআন তেলাওয়াতের সময় কান্নায় গলা ভারি হয়ে আসত। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, একবার সূর্যগ্রহণের সময় নবীজি (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ রুকুণ্ডসেজদা করলেন। সেজদায় গিয়ে মনে হলো, তিনি আর উঠবেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আর কাঁদছিলেন। দোয়ায় বলছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি আমাকে এ প্রতিশ্রুতি দেননি যে, আমার উপস্থিতিতে উম্মতকে শাস্তি দেবেন না?’ (সুনানে নাসায়ি : ১২১৪)।
কোরআন শুনে কান্না
অন্যের কোরআন তেলাওয়াত শুনে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়। আর আমি আপনাকে কোরআন পড়ে শোনাব!’ তিনি বললেন, ‘আমি অন্যদের কাছ থেকে কোরআন শুনতে পছন্দ করি।’ এরপর তার অনুরোধে আমি এ আয়াত পাঠ করি, ‘যখন আমি সব উম্মতের একজন সাক্ষী আনব এবং আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আনব, তখন কেমন হবে?’ (সুরা নিসা : ৪১)। আয়াতটি পাঠের পর আমি মাথা তুলে দেখি, তার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত। (বোখারি : ৫০৫৫)।
কবর জেয়ারতে কান্না
কবর দেখলে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ মায়ের কবর জেয়ারত করে কান্না করেন। আশপাশের সবাইও কান্না করে। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমার রবের কাছে মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করি, আমাকে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার কবর জেয়ারতের আবেদন করলে অনুমতি দেওয়া হয়। অতএব, তোমরা কবর জেয়ারত করো। কেননা, তা তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করাবে।’ (মুসলিম : ৯৭৬)।
আরেকটি হাদিসে এসেছে, বারা বিন আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমন সময় তিনি একদল লোক দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, ‘তারা কেন সমবেত হয়েছে?’ কেউ বলল, ‘তারা কবর খুঁড়ছে।’ রাসুল (সা.) চিন্তিত মনে দ্রুত পায়ে কবরের দিকে ঝুঁকলেন। তিনি কী করেন, তা দেখতে আমিও তার সামনে গেলাম। তিনি প্রচণ্ড কান্না করলেন। তার অশ্রুতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘ভাইয়েরা! এ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪৩৩৫)।
সন্তানের শোকে কান্না
আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ সন্তান ইবরাহিমকে কোলে নিয়ে চুমু খেলেন ও সুগন্ধি নিলেন। কয়েক দিন পর আমরা আবার ওখানে যাই। তখন ইবরাহিমের মুমূর্ষু অবস্থা। রাসুল (সা.)-এর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। তখন আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও (কান্না করছেন)?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে ইবনে আউফ! এটা রহমতস্বরূপ।’ এরপর বললেন, ‘চোখ অশ্রুসিক্ত। অন্তর ব্যথিত। আমরা শুধু আমাদের রবের সন্তুষ্টিদায়ক কথাই বলব। হে ইবরাহিম, আমরা তোমার বিচ্ছেদে ব্যথিত।’ (বোখারি : ১৩০৩)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুল (সা.) এক মুমূর্ষু মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। বুকে রাখা অবস্থায় মেয়েটি মারা গেল। তখন উম্মে আইমান চিৎকার করে উঠল। কেউ বলল, ‘তুমি রাসুল (সা.)-এর সামনে কান্না করছ?’ উম্মে আইমান বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি কি আপনাকে কাঁদতে দেখিনি?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি কান্না করি না; বরং তা বিশেষ রহমত। মোমিন সর্বাবস্থায় ভালো থাকে। সে আল্লাহর প্রশংসা করা অবস্থায় তার আত্মা বের হয়।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ২৯১৪)।
পরিবারের মৃত্যুতে কান্না
উসামা বিন যায়েদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর কন্যা তার কাছে সংবাদ পাঠিয়েছেন, তার সন্তান মৃতপ্রায়। তিনি কয়েকজন সাহাবিসহ সেখানে গেলেন। শিশুটিকে নবীজি (সা.)-এর কোলে তুলে দেওয়া হলো। তখনও শিশুটির প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ধারণা করলাম, তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হয়, যেন একটি চামড়ার পাত্র।’ তারপর তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। সাদ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কী?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটাই মমতা, যা আল্লাহ তার বান্দাদের অন্তরে রেখেছেন। আল্লাহতায়ালা তার দয়ালু বান্দাদেরই দয়া করেন।’ (মুসলিম : ৯২৩)।
উম্মতের জন্য কান্না
আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) ইবরাহিম (আ.)-এর কথা তেলাওয়াত করলেন, ‘হে আমার রব! তারা বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। তাই যারা আমার অনুসরণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত; আর যারা আমার অবাধ্য হবে, (তাদের ব্যাপারে) আপনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৬ )। আর ঈসা (আ.) বলেছেন, ‘আপনি তাদের শাস্তি দিলে তারা আপনার বান্দা; আর ক্ষমা করলে আপনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়িদা : ১১৮)। অতঃপর রাসুল (সা.) দু’হাত তুলে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে জিবরাইল! মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আপনি কাঁদছেন কেন?’ মহান আল্লাহ সবকিছুই অবগত আছেন। তবু জিবরাইল (আ.) এসে জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল (সা.) তাকে নিজের কথা বললেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে জিবরাইল! তুমি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে বলো, আমি দ্রুত আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’ (মুসলিম : ২০২)।
সাহাবিদের ভালোবাসায় কান্না
আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) যায়েদ ও তার সঙ্গীদের শাহাদতের সংবাদ দিয়ে বললেন, ‘যায়েদ পতাকা তুলে নিয়েছে। সে শহীদ হলো। তারপর জাফর পতাকা ধরেছে। সেও শহীদ হয়ে গেল। এবার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা হাতে নিয়েছে। সেও শহীদ হয়েছে।’ বর্ণনাকারী বলেন, নবীজি (সা.)-এর দু’চোখ বেয়ে তখন অশ্রু ঝরছিল। (বোখারি : ৩০৬৩)। কখনও তিনি এত বেশি বেদনাহত হতেন যে, হৃদয়ে তার ছাপ থেকে যেত। একসঙ্গে অনেক কারির শাহাদতের ঘটনা সম্পর্কে আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-কে এর চেয়ে বেশি বেদনাহত হতে দেখিনি। (মুসলিম : ৬৭৭)।