আল্লাহ মানুষকে তাঁর আনুগত্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর আনুগত্য মানুষকে তাঁর সন্তুষ্টির পথ দেখায়। আল্লাহ মানুষকে তাঁর অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন; যা তার ক্রোধের কারণ। কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে, আর অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ সচেতনতা কাম্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! আল্লাহকে যথাযথ ভয় কর। আর প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২)।
অধিকার আদায়ে সতর্কতা
আল্লাহতায়ালা ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সবার হক সঠিকভাবে পালন করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদের হক পালন কর। তবে কিছুতেই অপব্যয় কোরো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও হক আদায় কর। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, এটা তাদের জন্য উত্তম। তারাই সফলকাম।’ (সুরা রুম : ৩৮)। তা ছাড়া রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে তোমার কোনো উপকার করবে, তাকে পুরস্কৃত করবে এবং যদি তুমি তার প্রতিদান দেওয়ার মতো কিছু না পাও, তবে তার জন্য দোয়া করো; যতক্ষণ না তুমি জানতে পার যে, তুমি তাকে পুরস্কৃত করেছ।’ (মুসনাদে আহমদ)।
বাবা-মায়ের ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত
আল্লাহতায়ালা বিয়েকে আইনসিদ্ধ করেছেন। অশ্লীলতাকে হারাম করেছেন। পিতামাতাকে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। সন্তানের দায়িত্ব ও যত্ন নেওয়ার কর্তব্য দিয়েছেন। আল্লাহ পিতামাতার অন্তরে সন্তানের জন্য মায়া-মহব্বত, সহানুভূতি আর করুণা দান করেছেন। পিতামাতার ত্যাগ এবং ভালোবাসা স্মরণ করা উচিত। স্মরণ করা উচিত, একটু সুখে রাখার জন্য বাবা-মা কত পরিশ্রম করেছেন! সন্তানের ইচ্ছা পূরণে পিতামাতা কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন! সন্তানকে তৃপ্ত করানোর জন্য পিতামাতা কতটা ক্ষুধার্ত থেকেছেন! সন্তানের শান্তির জন্য তারা কতটা অনিরাপত্তায় থেকেছেন। আল্লাহতায়ালা পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে থাকার কথা বলেছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বিনয়াবনত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
পিতামাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট
আল্লাহতায়ালা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অধিকারকে নিজের অধিকার বলেছেন। তাদের সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। সন্তানের প্রতি তাদের ক্রোধে আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন। পিতামাতার অবাধ্যতা করে জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়রা যা ত্যাগ করে যান, সেসবের জন্যই আমি উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদের সঙ্গে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ, তাদের প্রাপ্য দাও। আল্লাহতায়ালা নিঃসন্দেহে সবকিছুই দেখেন।’ (সুরা নিসা : ৩০)।
পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়া
পিতামাতার সবচেয়ে বড় হক হচ্ছে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, তাদের প্রতি সদয় হওয়া, তাদের প্রয়োজন পূরণ করা, তাদের প্রতি সবকিছুতে অনুগ্রহ করা। বিশেষ করে, তারা যখন বয়স্ক হয়ে যাবে অথবা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন তাদের পুরোপুরি যত্ন নেওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত কোরো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে পৌঁছে, তবে তাদের উহ্ শব্দটিও বোলো না। তাদের ধমক দিও না; শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। তাদের সঙ্গে নম্র আচরণ কর। আর বলো, হে আমার পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)।
অমুসলিম হলেও অনুগ্রহের নির্দেশ
পিতামাতা অমুসলিম হলেও আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি সদয় ও মেহেরবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। আরও নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। পিতামাতা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়ে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে। তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞাত করব।’ (সুরা লোকমান : ১৪-১৫)।
পিতামাতার জন্য দোয়ার তাগিদ
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্ট সহ্য করে গর্ভধারণ করেছে। কষ্ট করে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে ত্রিশ মাস লেগেছে। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যরে বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি তোমার নেয়ামতের শোকর করি; যা তুমি দান করেছ, আমাকে ও আমার পিতামাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদের সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমার কাছে তওবা করলাম; আমি এমন লোকদের সুকর্মগুলো কবুল করি এবং মন্দ কর্মগুলো মার্জনা করি। তারা জান্নাতিদের তালিকাভুক্ত সেই সত্য প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তাদের দান করা হতো।’ (সুরা আহকাফ : ১৫-১৬)।
পিতামাতা জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম
রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতামাতা হচ্ছে জান্নাতে প্রবেশের দরজা। সুতরাং সেই দরজাকে সংরক্ষণ করো।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। একবার রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, সেই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, সেই ব্যক্তি ধ্বংস হোক।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সেই ব্যক্তি কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি বাবা অথবা মা কিংবা উভয়কে বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না। (অর্থাৎ পিতামাতার খেদমতের মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারে)।’
জীবনের বড় জিহাদ
পিতামাতার সন্তুষ্টি অর্জন আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম পন্থা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কী?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘সময়মতো সালাত আদায় করা।’ বললাম, ‘এরপর কোন আমল আল্লাহর প্রিয়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘পিতামাতার প্রতি সদাচরণ।’ বললাম, ‘এরপর কোন আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এ হাদিসে রাসুল (সা.) জিহাদের চেয়েও বাবা-মায়ের প্রতি সদাচরণের বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, একবার এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার বাবা-মা জীবিত আছেন?’ সে বলল, ‘জ্বি’। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে তাদের মধ্যেই তোমার জিহাদ। (অর্থাৎ পিতামাতার খেদমতেই তোমার জিহাদ)।’ (বোখারি)।
৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৪ (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২) তারিখে প্রদত্ত মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন আল মামুন নূর