আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। সবাই এসে যার যার উম্মত?কে বুঝিয়েছেন, তোমাদের সৃষ্টিজীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, বিবেক-বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে দুনিয়ায় তোমাদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তুমি চাইলে ভালো কাজ করতে পার, চাইলে খারাপ কাজও করতে পার। চাইলে ঈমান আনতে পার, চাইলে কুফরি করতে পার। ইচ্ছে হলে কথা মানতে পার, ইচ্ছে হলে নাও মানতে পার। তবে জেনে রেখ, মানাটা তোমার কল্যাণ বয়ে আনবে, আর না মানা তোমার কল্যাণকর মনে হতে পারে; কিন্তু তা উভয় জগতে অকল্যাণ বয়ে আনবে। চোখ বন্ধ হলে যে স্থায়ী জগৎ শুরু হবে, সে জগতে তুমি নিঃস্ব হয়ে যাবে। কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘হে নবী! আপনার উম্মতদের বলুন, সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছে বিশ্বাস স্থাপন করুক, আর যার ইচ্ছে অমান্য করুক। আমি জালেমদের জন্য শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি; যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে থাকবে। যদি তারা পানীয় চায়, তবে পুঁজের মতো পানীয় দেওয়া হবে; যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। তা কত নিকৃষ্ট পানীয় এবং খুবই মন্দ আশ্রয়!’ (সুরা কাহফ : ২৯)।
বিবেক খাটিয়ে ইচ্ছাধিকার প্রয়োগ কাম্য
আমাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত সেই ইচ্ছাধিকার বিবেকের মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শতভাগ বিশ্বাস করতে হবে- আল্লাহ মহান, পরাক্রমশালী, সব শক্তির অধিকারী। তিনি যা ইচ্ছে করতে পারেন। কোনো কিছু করতে তার কোনো সহযোগিতা লাগে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তার রাজত্ব আল্লাহর। তিনি সবকিছুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।’ (সুরা মায়িদা : ১২০)। মানুষ যেহেতু আল্লাহকে দেখেনি, তাই তাকে চিনতে এবং তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হতে সে বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে উপমা অনুসন্ধান করবে। মনে করবে, আমরা যেহেতু বড় কোনো কাজ করলে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব হয় না, অবশ্যই কারও না কারও সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাই পৃথিবীর এত বড় বড় কাজ করতে নিশ্চয়ই আল্লাহর হয়তো কোনো সহযোগিতা লাগে। (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাবে না। সবকিছু করার জন্য তিনিই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। যেমন তিনি বলেন, ‘আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ কোরো না। আল্লাহ যা জানেন, তোমরা তা জানো না।’ (সুরা নাহল : ৭৪)।
আল্লাহ মহান ক্ষমতার অধিকারী
আল্লাহর সঙ্গে কোনো অংশীদারিত্বের সুযোগ নেই। তাঁর কোনো শরিক নেই, সমকক্ষ নেই। তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ। সন্তানাদি থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই তো তাঁর।’ (সুরা নিসা : ১৭১)। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-সহ যত নবী দুনিয়াতে এসেছেন, সবাই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বিধানাবলি কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন ছাড়াই হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যেমন শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি তার নিজ খেয়ালখুশি মতো কিছু বলেন না। এটা তো বিশুদ্ধ ওহি, যা তার কাছে পাঠানো হয়।’ (সুরা নাজ?ম : ৩-৪)। কোনো নবীর নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার অধিকার ছিল না। কোনো নবী যদি সামাজিক প্রভাবে বা তার উম্মতদের আকৃষ্ট কিংবা প্রভাবিত করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলতেন বা বলার চেষ্টা করতেন, তাহলে আল্লাহ তাকে ছাড় দিতেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি সে (রাসুল) কোনো (মিথ্যা) বাণী রচনা করে, আমার প্রতি আরোপ করত, তবে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। তারপর তার জীবন-ধমনি কেটে দিতাম। তখন তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করার জন্য বাধা হতে সক্ষম হতো না।’ (সুরা হাক্কাহ : ৪৪-৪৭)। নবী-রাসুলরা নিষ্পাপ, ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তারা কখনও আল্লাহর বিধানাবলিতে সামান্য সংযোজন-বিয়োজনের চিন্তাও করেননি।
আমাদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা কম
দুনিয়ায় মানুষ মানুষের প্রয়োজন কিছুটা বোঝে। তারপরও যেমন দুনিয়ার অতি ধনীরা অসহায় হতদরিদ্রদের কষ্ট ততটা অনুভব করতে পারে না, আর আল্লাহতায়ালা তো মহান। তার কোনো অভাব নেই, কোনো প্রয়োজন নেই, তাহলে তিনি আমাদের অভাব, প্রয়োজন কীভাবে বুঝবেন? দুনিয়ার মানুষ তো সামান্য জ্ঞানের অধিকারী। তাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। দৃষ্টিসীমার বাইরে দেখতে পারে না, শ্রবণসীমার বাইরে শুনতে পারে না। অনুভবসীমার বাইরে অনুভব করতে পারে না। অথচ আল্লাহতায়ালা মহাজ্ঞানী, সব বিষয়ে খবর রাখেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি হলে জ্ঞানীর তুলনায় মহাজ্ঞানী।’ (সুরা ইউসুফ : ৭৬)। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে, আমাদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা দুর্বল। আমাদের জ্ঞান আহরণের পরিধি সীমিত। পাওয়ার কম, রেঞ্জ কম। ভুল হতে পারে। কোনো একটা বিষয় কল্যাণকর মনে করলেও সেটা অকল্যাণকর হতে পারে। আমাদের জ্ঞানে বিভিন্ন প্রভাব থাকবে। প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে বিভিন্ন স্বার্থ লুকিয়ে থাকতে পারে। অথচ আল্লাহতায়ালা আমাদের যত নির্দেশ দিয়েছেন, যত বিধানাবলি আবশ্যক করেছেন, তা শতভাগ সত্য, কল্যাণকর এবং সবার জন্য উপকারী।
বিচারের সম্মুখীন হতে হবে
পরকালে সফলতার জন্য এসব বিষয়ের প্রতি আমাদের শতভাগ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। যদি বিশ্বাস না করি, তাহলে আল্লাহতায়ালা আমাদের বাধ্য করবেন না। আল্লাহতায়ালা দ্বীন কবুল করতে কাউকে বাধ্য করেন না।? যদি বাধ্য করতেন, তাহলে প্রত্যেকেই আল্লাহতায়ালাকে মেনে নিতে বাধ্য হতো। এদিক-সেদিক করার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু আল্লাহতায়ালা দেখতে চান, তার বান্দাদের মধ্যে কারা ঈমান আনে আর কারা কুফরি করে? কারা ভালো কাজ করে, আর কারা নাফরমানি করে? দুনিয়ায় যে যা-ই করুক, যতই পাপাচারে লিপ্ত হোক, আল্লাহতায়ালা হয়তো বা কিছু বলবেন না, তবে পরকালে তাদের অবশ্যই ধরা খেতে হবে, বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(কেয়ামতের দিন বলা হবে) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১৪)। তিনি আরও বলেন, ‘আমলনামা (তাদের) সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে, তার কারণে আপনি অপরাধীদের ভীতসন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে, হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।’ (সুরা কাহ?ফ : ৪৯)। আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই মোমিন। প্রত্যেকেই পরকালে বিশ্বাসী, জান্নাত-জাহান্নামে বিশ্বাসী। আমরা ইহ-পরকালে আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই। পরকালে চিরস্থায়ী শান্তি চাই। তাই আমাদের সেভাবেই জীবন পরিচালনা করতে হবে। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবন কোনো না কোনোভাবে চলেই যাবে। ধনী হই বা গরিব, কৃষিজীবী হই বা চাকরিজীবী, ভালো খাই বা খারাপ, দিন কেটেই যাবে। এভাবেই জীবনের বাতিটি নিভে যাবে একদিন। সময় থাকতে তাই সাবধান হতে হবে।
১৫ আশ্বিন ১৪২৯ (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২) তারিখে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রদত্ত জুমার বয়ানের সংক্ষেপিত শ্রুতলিখন করেছেন মুফতি মাহবুবুর রহমান