সম্পদ আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত। সম্পদের মাধ্যমে দুর্দশা দূর হয়। ভালো কাজ করা যায়। প্রশংসা অর্জিত হয়। ভালো মানুষের জন্য সম্পদ অনেক বড় নেয়ামত। মানুষের জীবিকা অর্থের ওপর নির্ভর করে। সম্পদকে মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে, মানুষের কাছে একটি প্রিয় বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্তুতি, রাশিকৃত সোনা-রুপা, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তু। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর কাছেই হলো উত্তম আশ্রয়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪)।
সবকিছুই সৃষ্টির কল্যাণের জন্য
পৃথিবীতে উত্তম যা কিছু আছে, সবকিছু আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণের জন্য। সুতরাং আমাদের আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই সাহায্য চাইতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, তা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের আয়ত্তাধীন করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সুরা জাসিয়াত : ১৩)। সব নবী এবং তাদের অনুসারীদের সুন্নত হলো, হালাল উপার্জন করা এবং হালাল খাবার গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! হালাল ও উত্তম খাবার গ্রহণ করুন এবং উত্তম আমল করুন।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)।
সম্পদ ঈমানের পরীক্ষা
আগের সব উম্মতকে আল্লাহ বিভিন্ন ধরনের বিপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। আর এ উম্মতের জন্য পরীক্ষা হলো, সম্পদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্যই ফেতনা ছিল। আর আমার উম্মতের জন্য ফেতনা হলো, ধন-সম্পদ।’ (মুসনাদে আহমদ)। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে তার উপার্জন এবং খরচের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেয়ামতের দিবসে কোনো বান্দা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে তার বয়স, জীবনের সময় ব্যয়, অর্জিত জ্ঞান, সম্পদ (তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে) এবং তার শরীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’ (তিরমিজি)।
লেনদেনে নৈতিকতার মাপকাঠি
অর্থের লেনদেন মানুষের নৈতিকতার মাপকাঠি এবং পুরুষত্বের ক্ষেত্র। অর্থের লেনদেনে সততা এবং বিশ্বস্ততা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। দ্বীনের পূর্ণতার নিদর্শন। বান্দার হক তথা অধিকার আদায়ে সচেতনতার লক্ষণ। আল্লাহতায়ালা একজন আরেকজনের সম্পদ ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, এর মাধ্যমে শত্রুতা এবং ঘৃণার ইন্ধন হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ৮৮)। অর্থের পবিত্রতা রক্ত ও সম্মানের পবিত্রতার মতো। রাসুল (সা.) কোরবানির দিন মিনায় ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ এবং সম্মান সেরকম পবিত্র, যেমন আজকের দিন, মাস এবং এ শহর পবিত্র।’ (সুনানে নাসাঈ)।
অস্বচ্ছ লোকদের জন্য শাস্তি
অর্থ দিয়ে মানুষের সঙ্গে লেনদেন করা একটি অনুমোদিত নীতি। এটি মানুষের জীবনে অপরিহার্য। তারা শুধু সততা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে এটিকে উপকৃত ও উপভোগ করতে পারে। শয়তানের মানুষের আর্থিক লেনদেনে অনেক হস্তক্ষেপ রয়েছে। যারা আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা অবলম্বন করে, তাদের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে অনেক ভয়ংকর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যারা শয়তানের ফাঁদে পড়ে এবং অন্যায়ভাবে যে কোনো ধরনের মানুষের সম্পদ গ্রাস করে, তাদের জন্য কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে।
সততা ও স্বচ্ছতা লেনদেনের মূল
সততাণ্ডস্বচ্ছতা মানুষের সঙ্গে লেনদেনের মূল। ক্রেতাণ্ডবিক্রেতা যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথক না হয়, ততক্ষণ লেনদেনে তাদের স্বাধীনতা থাকবে। যদি উভয়ে সৎ এবং স্বচ্ছ হয়, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয় বরকতময় হয়। বিতর্কিত সম্পদ, অন্যায়ভাবে দখল করা সম্পদ কিংবা মালিকানা নেই, এমন সম্পদ অন্যের কাছে বিক্রি করা নিষেধ।
নষ্ট পণ্য বিক্রি করা অন্যায়
খারাপ অথবা নষ্ট পণ্য বিক্রি করা, ক্রেতার কাছে পণ্য সম্পর্কে সবকিছু স্পষ্ট না করা অথবা ক্রেতাকে ঠকানোর ব্যাপারে অনেক বড় শাস্তির কথা বলা হয়েছে। একবার রাসুল (সা.) একটি খাবারের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাবারের ভেতরে হাত রাখলেন। ভেজা অনুভব করলেন। রাসুল (সা.) দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাবারের মধ্যে এগুলো কী?’ দোকানদার বলল, ‘বৃষ্টির পানিতে এমন হয়েছে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে তুমি কেন নষ্ট খাবার ওপরে রাখনি, যাতে ক্রেতারা তোমার খাবারের আসল মান বুঝতে পারে? যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মত নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
উপার্জনে প্রতিযোগিতা বিভেদ সৃষ্টির কারণ
মোমিনরা ঐক্যবদ্ধ থাকে; তবে যা তাদের পৃথক করে, তা হলো- অর্থের প্রতি নিন্দনীয় প্রতিযোগিতা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হিংসা-ঝগড়া ও ঘৃণা করবে না এবং একে অপরকে বিক্রি করবে না।’ (মুসলিম)।
আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথের পরিণতি
যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে নিজের পণ্য প্রচার করার জন্য একটি পণ্যের ওপর মিথ্যাভাবে আল্লাহর নামে শপথ করে, সে তিনটি খারাপ কাজকে একত্রিত করেছে- মিথ্যা বলা, আল্লাহকে অবহেলা করা এবং ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিন ধরনের মানুষের সঙ্গে আল্লাহ কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।’ রাসুল (সা.) তিনবার এ কথা বললেন। আবু জর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তারা কারা?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে টাখনুর নিচে কাপড় পরে, অন্যের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য গর্ব করে এবং মিথ্যা শপথ করে।’ (মুসলিম)।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ঈমানের পরিচায়ক
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, চুক্তি ঠিক রাখা ও বেচাকেনার শর্তগুলো ঠিক রাখা দ্বীনের অন্যতম দাবি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো।’ (সুরা মায়িদা : ১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য দুর্ভোগ। যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)।
সুদের ভয়াবহতা
যে সুদ খায়, সে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি নেয়। যখন সে দুর্বলদের কাছে তার শক্তি প্রদর্শন করে, তখন যেন সে শক্তিশালী আল্লাহর সঙ্গে লড়াই করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যেসব বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর; যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। আর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার কোরো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।’ (সুরা বাকারা ২৭৮-২৭৯)। সুদখোররা অভিশপ্ত। জাবের (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সুদগ্রহীতা, দাতা ও সুদের হিসাব রক্ষকসহ সবার ওপর অভিশাপ করেছেন।’ (মুসলিম)।
ঘুষ গ্রহণ করা মহা অন্যায়
কোনো ব্যক্তি যদি উপহারের নামে ঘুষ গ্রহণ করে কারও পক্ষে কথা বলে অথবা সুযোগ গ্রহণ করে, তাহলে কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি ওই সম্পদসহ আল্লাহর সামনে হাজির হবে।
আমানত রক্ষার গুরুত্ব
রাসুল (সা.) আমানত রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। হিরাক্লিয়াস যখন আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.) আপনাদের কী করার আদেশ দেয়?’ তখন জবাবে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, ‘সে আমাদের এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য বলে। শিরক থেকে বিরত থাকতে বলে। সালাত আদায় করতে বলে। সদকা করতে বলে। ওয়াদা ও আমানত রক্ষা করতে বলে।’ (বোখারি)। এটি এমন এক বিষয়, যার জন্য কেয়ামতের দিন বান্দাকে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে জবাবদিহি করতে হবে।
এতিমদের হক না দেওয়া জুলুম
এতিমদের অভিভাবক কিংবা দায়িত্বশীল যদি তাদের হক ঠিকমতো আদায় না করে অথবা তাদের অধিকার প্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তারা জালেম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে। অতি সত্ত্বর তারা আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : ১০)। যার হাতে আমানত বা ঋণ আছে, সে তা অস্বীকার করে অথবা তা সংরক্ষণে অবহেলা করে এবং লুণ্ঠন করে কিংবা তা ভাড়া দিয়ে লুণ্ঠন করে বা মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তারা অকৃতজ্ঞ। বনু মাখঝুমের এক নারী কিছু জিনিস ধার করে পরে অস্বীকার করেছিল। রাসুল (সা.) পরবর্তী সময়ে তার হাত কেটে ফেলার আদেশ দিয়েছিলেন। (মুসলিম)। আর যে ব্যক্তি সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকারীকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করে বা তা হ্রাস করে বা গোপন করে, সে স্পষ্ট হারাম কাজ করল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘উত্তরাধিকারীদের সম্পদ তাদের মাঝে বণ্টন করে দাও। যে ব্যক্তি তার শক্তি, অভিভাবকত্ব দিয়ে দুর্বল মা, স্ত্রী বা কন্যাকে গালি দেয় এবং তাদের অর্থ হাতিয়ে নেয়, সে যেন তার ওপর আল্লাহর শক্তির কথা স্মরণ করে।’ (মুসলিম)।
জমি দখল করার ভয়াবহ পরিণতি
যে ব্যক্তি কোনো জমি দখল করে বা তার সীমানা অন্যায়ভাবে পরিবর্তন করে, তাকে জাতিগত অন্যায়ের শাস্তি দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি এক ইঞ্চি জমিতেও অন্যের ওপর জুলুম করবে, তাকে সাতটি ভূমি দ্বারা বেষ্টিত করা হবে। আর যে ব্যক্তি তার শপথের মাধ্যমে কোনো মুসলমানের হক হরণ করবে, যদিও তা সামান্যই হোক, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম আবশ্যক করে দেবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শপথ করেও কোনো মুসলমানের হক নষ্ট করবে, তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম আবশ্যক করে দেবেন এবং জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (মুসলিম)।
সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও সাহায্য চাওয়া অন্যায়
যিনি দারিদ্র্য বা মারাত্মক মহামারি ছাড়াই মানুষের কাছে তাদের অর্থ তথা সাহায্য চান, তিনি মূলত কয়লা চাইছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও কারও কাছে সাহায্য চায়, জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করার জন্য উত্তাপ বাড়ানো হবে।’ লোকেরা বলল, ‘সচ্ছলতা কী?’ তিনি বললেন, ‘এক রাতের খাবার।’ (মুসলিম)। মানুষের মধ্যে প্রতিটি এমন লেনদেন, যাতে অন্যায়, ক্ষতি, প্রতারণা রয়েছে বা আল্লাহতায়ালা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
নিষিদ্ধ অর্থ সীমিত হলেও অভিশপ্ত
রিফাআ (রা.) একবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজের জন্য বেরুলেন। মানুষকে দেখা গেল, তারা ক্রয়-বিক্রয় করছে। রিফাআ (রা.) বললেন, ‘হে ব্যবসায়ীরা! তোমরা রাসুল (সা.)-এর কথা শোন।’ তারা রাসুল (সা.)-এর দিকে তাকাল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেয়ামতের দিন সত্যবাদী এবং আল্লাহভীরু ব্যবসায়ী ছাড়া সবাইকে পাপাচারী হিসেবে উপস্থিত করা হবে।’ (তিরমিজি)।
৯ রবিউস সানি ১৪৪৪ (৪ নভেম্বর ২০২২) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আল মামুন নূর