পাপ থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা ও পুণ্যের পোশাক পরিধান করা মানুষ হিসেবে আমাদের পূর্ণতার পরিচায়ক। মারাত্মক পাপগুলোর অন্যতম হচ্ছে হিংসা। হিংসা মূলত আমাদের কষ্টের দিকে আহ্বান করে। হিংসা হতাশা এবং নীচতার লক্ষণ। হিংসুকের তিনটি নিদর্শন- ১. উপস্থিত ব্যক্তির অতিরিক্ত প্রশংসা করা, ২. অনুপস্থিত ব্যক্তির ব্যাপারে পরনিন্দা করা, ৩. বিপর্যয় কিংবা খারাপ সময়ে গালাগাল করা।
হিংসুকেরা কখনও তৃপ্ত হয় না
অন্যের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত দেখে যারা ঈর্ষান্বিত হয়, তারা মৃত্যুর আগে কখনোই নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবে না। এ ধরনের মানুষ কখনও সন্তুষ্ট হয় না। যখন কাউকে জ্ঞানে-গুণে, চরিত্রে, সম্পদে নিজের থেকে ভালো অবস্থায় দেখে, তখন আল্লাহর নেয়ামত নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আল্লাহর ফয়সালা নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়। নিজেকে দুর্ভাগা মনে করতে থাকে। আল্লাহর ফয়সালাকে ন্যায়বিচার হিসেবে দেখে না। যোগ্য লোকদের আল্লাহ যে নেয়ামত দিয়েছেন, তা ঘৃণা করে। হিংসুক সাধারণত যোগ্য লোকের প্রজ্ঞা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। যোগ্য লোকের নেয়ামতকে বিভিন্নভাবে ছোট করার চেষ্টা করে। আল্লাহ যাকে বিভিন্ন নেয়ামত দান করেছেন, তার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে।
হিংসুকেরা নিজেদের প্রতি অবিচার করে
এক বেদুইন বলেন, ‘হিংসুকের চেয়ে নিজের প্রতি বড় অত্যাচারকারী আমি কখনও দেখিনি। হিংসুকের জন্য মানসিক যন্ত্রণা অবশ্যম্ভাবী। এরা সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করে।’ আবুল লাইস সমরকন্দি (রহ.) বলেন, ‘হিংসাকারীর হিংসা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর আগে তাকে পাঁচটি শাস্তি দেওয়া হয়। যথা- অন্তহীন মানসিক যন্ত্রণা, সর্বদা বিপদ লেগেই থাকা, অপবাদ, আল্লাহ তার ওপর ক্ষুব্ধ থাকা ও সাফল্যের দরজা তার জন্য বন্ধ হওয়া।’ হিংসার নেতিবাচক দিক হলো- আয়ু হ্রাস পাওয়া ও চিন্তায় বিভ্রান্তি চলে আসা।
হিংসা একটি শারীরিক অসুস্থতা
ইবনুল মুতাজ (রহ.) বলেন, ‘হিংসা শরীরের রোগ।’ আসমায়ি (রহ.) বলেন, আমি মরুভূমিতে একজন বৃদ্ধকে দেখেছি, তার চোখের ভ্রƒ কুচকে গিয়েছিল। তার বয়স ছিল ১২০ বছর। কিন্তু সে শারীরিকভাবে সুস্থ ছিল। তাই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?’ সে বলল, ‘আমি হিংসা ত্যাগ করেছি; তাই আমার শরীর সুস্থ আছে।’
হিংসামুক্ত হওয়ার গুরুত্ব
যে নিজেকে হিংসা, পরনিন্দা, ঈর্ষা থেকে পবিত্র তথা শুদ্ধ করতে পারবে, তার অন্তরে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের প্রতি ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঈর্ষা থাকবে না। মদিনার আনসাররা ছিলেন সম্ভ্রান্ত, পরোপকারী এবং প্রভাবশালী গোত্রের। রাসুল (সা.) তাদের বাড়িতেই নিজেকে নিরাপদ মনে করলেন। ঈর্ষান্বিত না হয়ে তিনি সেখানে আগমন করলেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মুহাজিরদের আসার আগে মদিনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে, সেজন্য তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না। নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।’ (সুরা হাশর : ৯)। অর্থাৎ মুহাজিরদের যে আল্লাহ সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছিলেন, সে কারণে আনসারদের মনে মুহাজিরদের প্রতি কোনো ঈর্ষা ছিল না। আল্লাহ ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিদের তিরস্কার করেছেন। তাদের কাজকে অসম্মান এবং অপদস্থ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যা কিছু আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে দান করেছেন, সে বিষয়ে তারা কি মানুষকে হিংসা করে? অবশ্যই আমি ইবরাহিমের বংশধরদের কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করেছিলাম; আর তাদের দান করেছিলাম বিশাল রাজ্য।’ (সুরা নিসা : ৫৪)।
হিংসা একটি বড় গোনাহ
হিংসা করা মহাপাপ। কেননা, এ গোনাহ আমাদের ভালো কাজের নেকি নষ্ট করে দেয়। আমাদের অন্তহীন অনুতাপ করতে হয়। তাদের জন্য কতই না দুঃখ, যারা তাদের অন্তরে হিংসার আগুন জ্বালিয়েছে। দুঃখ তাদের জন্য, যাদের শয়তান ধোঁকা দিতে পেরেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘একে অপরকে ঘৃণা কোরো না, পরস্পর হিংসা কোরো না, একে অপরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। বরং পরস্পর ভাই হয়ে যাও।’ রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভালো থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ না করবে।’ ওমর (রা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানী হতে পারবে না, যতক্ষণ না অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা ছেড়ে দেবে। মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা ছেড়ে দেবে। নিজেকে জ্ঞানী মনে না করবে।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি আপনার পালনকর্তার রহমত বণ্টন করে? আমি পার্থিব জীবনে তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি; যাতে একে অপরকে সেবকরূপে গ্রহণ করে। তারা যা সঞ্চয় করে, আপনার পালনকর্তার রহমত তার চেয়ে উত্তম।’ (সুরা যুখরুফ : ৩২)।
লোভ-লালসা মানুষের ক্ষতি করে
যে ব্যক্তি সবকিছুর প্রতি লালসা করে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে; যা হিংসা ও অত্যাচারের জন্ম দেয়, সে ক্ষতিগ্রস্ত। হিংসার বশবর্তী হয়ে যে বলে, আমি যদি অনেক টাকার মালিক হতাম, আমি যদি অমুক পদ পেতাম, অন্যের স্ত্রী যদি আমার হতো, তাহলে বুঝতে হবে, এমন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেছে। তার কথা ও কাজে কদর্য রয়েছে। এমন ব্যক্তি অধৈর্য হয়, মূর্খ থেকে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আকাঙ্ক্ষা কোরো না এমন সব বিষয়ে, যাতে আল্লাহতায়ালা তোমাদের একের ওপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে, সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, তা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা সব বিষয়ে জ্ঞাত।’ (সুরা নিসা : ৩২)।
মর্যাদা ও অর্থের লোভ অন্ধ করে
মর্যাদা প্রাপ্তির আশা, নেতৃত্বের লোভ, অর্থ-পদ ও রাজ্যের লালসা না থাকলে কেউ অপর মুসলমান ভাইকে হিংসা করে না; কেউ কারও ওপর জুলুম করত না; অন্যকে আল্লাহ যে নেয়ামত দিয়েছেন, তার ওপর ঈর্ষা করত না। যদি কোনো গোত্রকে দেখি, তারা একে অপরের ওপর অত্যাচার করছে, তাদের মাঝে লোভ-লালসা বেড়ে গেছে, ঝগড়া-ঠাট্টা ও চোখের ইশারায় মতভেদ করছে, তখন এগুলো হবে পরশ্রীকাতরতা; বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ নয়। কোনো মানুষই হিংসামুক্ত নয়। উদার ব্যক্তি তা লুকিয়ে রাখে, খারাপ লোক প্রকাশ করে। যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে হিংসা খুঁজে পায় ও তা লুকিয়ে রাখে এবং জিহ্বা কিংবা হাত দিয়ে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তির ক্ষতি না করে, তাহলে তার ওপর কোনো দোষ বা অপবাদ নেই। যার বুক হিংসা, ক্ষোভ, ঘৃণা ও শত্রুতায় ভরে গেছে, ঈর্ষান্বিত ব্যক্তির সম্মানকে অতিরঞ্জিত করা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই তার। সে তাকে অপবাদ দিয়ে বলে, সে কি অমুক বলে না? সে কি তা করে না? সে তার দোষ গণনা করে, তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তার আসল গুণাবলি লুকিয়ে রাখে; এমনকি তার দোষগুলো তার গুণের সমুদ্রে নিমজ্জিত হলেও সে দোষচর্চা করেই যায়। এভাবেই ঈর্ষান্বিত ব্যক্তির নিন্দা করে।
১৫ রবিউস সানি ১৪৪৪ (১১ নভেম্বর ২০২২) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আল মামুন নূর