দাম্পত্য বা পারিবারিক জীবন মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবনের এ অংশ মানব জীবনের মূল। ব্যক্তিগত জীবনে জটিলতা ও সমস্যা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে; কিন্তু পারিবারিক জীবন তার ভিন্ন। পারিবারিক জটিলতা হয় পুরো পরিবার নিয়ে। তাই ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে পারিবারিক জীবনে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সাম্যের আহবায়ক পিয়নবী (সা.)-এর জীবনে যেমনিভাবে রয়েছে ব্যক্তিজীবনের পথপাথেয়, তেমনি রয়েছে পারিবারিক জীবনের নানা সমস্যার সমাধান। যেমনটি কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় রাসুলের জীবন-দর্শনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)।
রাসুল (সা.) আমাদের সহজ সমাধান
আলোচ্য আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, মানব জীবনে প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমাদের আদর্শ নবীজি (সা.)। ব্যক্তি জীবন থেকে পারিবারিক জীবন, পারিবারিক জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন- সর্বত্র রাসুল (সা.) আমাদের সহজ সমাধান। কিন্তু বড় আফসোস আর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম জাতি আজ ভুলে গেছে তার জীবনের জটিলতার সমাধান কোথায়! ভুলতে বসেছে কে তাদের অনুসৃত ব্যক্তি। তাদের স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে ঐশীবাণী, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর।’ যার ফলে মানুষ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে সম্মুখীন হয় হতাশা আর বিষণ্নতার। অবশেষে পা বাড়ায় আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে সিরাত থেকে দূরে সরে যাওয়া; যা আমাদের অনুসরণীয় পথ।
পারিবারিক জীবন ছিল একদম সাদাসিধে
নবীজি (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবন যেমন ছিল সাদামাটা, তেমনি তার পারিবারিক জীবনও ছিল একদম সাদাসিধে। যেমনটি আম্মাজান আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) নিজ ঘর নিজেই পরিষ্কার করতেন। বকরির দুধ দোহন করাসহ নিজের সব কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতেন।’ অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসুল (সা.) নিজের জুতা ও কাপড় সাধারণ মানুষের মতো নিজেই সেলাই করতেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৫৩৮০)। রাসুল (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্য সম্পর্কে আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) সব মানুষের চেয়ে বেশি নম্র-ভদ্র ছিলেন এবং সর্বদা হাসিখুশি থাকতেন।’ আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) কখনও খাবারে ভুল ধরতেন না। যদি ভালো লাগত, খেতেন; অন্যথায় রেখে দিতেন।’ (বোখারি : ৫১৯৮, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩৮২)।
স্ত্রীদের মানসিক প্রশান্তির জন্য ক্রীড়া-কৌতুক
স্ত্রীদের মানসিক প্রশান্তির জন্য রাসুল (সা.) তাদের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুক করতেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে; এক সফরে তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তখন তিনি কিশোরী। রাসুল (সা.) সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও।’ অতঃপর তিনি আয়েশা (রা.)-কে বললেন, ‘এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি।’ আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং দৌড়ে তাঁর চেয়ে এগিয়ে গেলাম।’ (আস সুনানুল কোবরা লিন নাসায়ি : ৮৯৪৫)। রাসুল (সা.) নিজ পরিবারে আদর্শ শ্রেষ্ঠ গৃহকর্তা হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম, যে তার পরিবার-পরিজনের কাছে অতি উত্তম। আর আমি আমার পরিবারে সবচেয়ে আচরণের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৯৭৭, তিরমিজি : ৩৮৯)।
ঋতুমতী নারীদের ঘৃণার দ্বার বন্ধ করেছেন
যে সময় গোটা আরবে জাহেলিয়াত ছেয়ে গিয়েছিল, নারীরা শিকার হতো বৈষম্যের, দাস-দাসী পেত না তাদের প্রাপ্য অধিকার, তখন রাসুল (সা.) আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর পানপাত্রের যে স্থান দিয়ে পানি পান করেছেন, সেই স্থান দিয়ে পানি পান করে ঋতুমতী নারীদের ঘৃণার পাত্রের দ্বার চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন, যা আজ ইতিহাস সাক্ষী। রাসুল (সা.) শুধু একজন নবীই ছিলেন না, ছিলেন সব নবীর সরদার। সর্বশেষ নবী হয়েই ক্ষ্যান্ত নন, ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়কও। তিনি ছিলেন জাজিরাতুল আরবের বাদশাহ। তাঁর পারিবারিক জীবনের অবস্থা যদি এরূপ হয় যে, তিনি বাদশা হয়েও নিজ হাতে নিজের জুতা সেলাই করেন, বকরির দুধ দোহন করেন, নিজের ঘরের সব কাজ নিজেই আঞ্জাম দেন, তাহলে আজ আমরা কোথায়! তার আদর্শ থেকে কত দূরে! আজ যদি মুসলিম উম্মাহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বত্র রাসুল (সা.)-এর সুন্নত আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করে, তাহলে জীবনের সব ক্ষেত্রে সব ধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।