প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ জুন, ২০২৩
ইসলামি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত নাম বেলাল। পিতা রাবাহ, মাতা হামামাহ। তিনি হাবশি ক্রীতদাস। তার জন্ম মক্কায়। বনুজুরহাম তার মনিব ছিল। হাবশি হওয়ায় গায়ের রং যদিও কালো ছিল; কিন্তু অন্তর ছিল ধবধবে সাদা, স্বচ্ছ-সফেদ। তাতে ছিল না কোনো পাপ-পঙ্কিলতা। নবী (সা.) সত্য দিনের আওয়াজ তুললে, মক্কার অহংকারী নেতারা কঠোর বিরোধিতায় লেগে যায়। তখন অল্প যে কয়েকজন ঈমানের বরকত লাভে ধন্য হন, তাদের মধ্যে যে সাত জন প্রকাশ্যে ইমানের ঘোষণা দেন তাদের অন্যতম বেলাল (রা.)। (আসহাবে রাসুলের জীবন কথা : ১ : ১১২)।
বেলাল (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার অপরাধে তার মনিব তাকে খুব নির্যাতন করত। যুগযুগ ধরে অত্যাচারের স্টিমরোলার দুর্বলের ওপরেই চলে এসেছে। বেলালের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সামাজিক নিম্ন অবস্থানের কারণে অমাবস্যার কালো মেঘে ছেয়ে যায় জীবন। নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রতিদিন প্রয়োগ করা হতো নিত্যনতুন শাস্তি। মরুর জ্বলন্তপ্রায় বালু, পাথর এবং জ্বলন্ত আংগারে শুইয়ে বুকে চেপে দেয়া হতো শক্ত পাথর। কখনো ছাগলের মতো গলায় রশি পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে ঘুরানো হতো মক্কার অলিতে-গলিতে। শক্ত পাথরের আঘাত ও খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত শরীর। এতশত কষ্ট সহ্য করেছেন, তবুও তিনি ঈমান ত্যাগ করেননি। অভিশপ্ত আবু জাহেল বেলালকে উপুড় করে শুয়িয়ে দিয়ে বুকের ওপর বড় পাথরখণ্ড চাপিয়ে দিত। দুপুরে রোদের প্রখরতা ও পাথুরে বালুর উত্তপ্ততায় যখন কষ্ট শত গুণ বেড়ে যেত তখন বলত, বেলাল! এখনো মুহাম্মদের আল্লাহ থেকে ফিরে আয়। উত্তরে তার মুখ থেকে বের হতো মধুর শব্দ আহাদ, আহাদ। আল্লাহ এক। আল্লাহ এক।
উমাইয়্যা বিন খালফ বেলালকে শাস্তি দানে বেশি উৎসাহী ছিল এবং সেই নিত্যনতুন শাস্তির কলা-কৌশল বের করত। কখনো দুর্গন্ধময় উটের চামড়ায় পেঁচিয়ে, আবার কখনো লোহার পোশাক পরিয়ে দুপুরের অগ্নিবর্ষিত রোদে বসিয়ে দিয়ে বলত, তোমার আল্লাহ লাত, উজ্জা। কিন্তু বেলাল, ধৈর্যের ইস্পাতকঠিন পাহাড়। এক আল্লাহর ঈমানে অটল, অনড়। তার পবিত্র মুখে উচ্চারিত হতো পবিত্র নাম। আহাদ আহাদ। কাফেরেরা বলত, বেলাল! আমরা যে শব্দগুলো বলি সেগুলোই বল, তিনি উত্তর দিতেন তোমাদের শব্দগুলো আমি উচ্চরণ করতে পারি না।
একদিন আবুবকর (রা.) কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি বেলালের শাস্তি ভোগ করার দৃশ্য দেখে কষ্ট পেলেন, শঙ্কিত হলেন। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বেলালকে কিনে আজাদ করে দিলেন।
মদিনার মুয়াজ্জিন
মদিনায় রাসুলের মসজিদ নির্মাণ হলে, বেলালকেই প্রথম আজানের দায়িত্ব দেয়া হয়। বেলালের সুমধুর আজান শুনে মদিনার ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কেউ ঘরে থাকতে পারত না। সবাই সমবেত হতো মসজিদে। বেলাল রাসুলের দরজায় গিয়ে আওয়াজ দিতেন হাইয়্যা আলাস সালাহ! তখন রাসুল বের হয়ে সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়তেন। রাসুলের ইন্তেকালের পরে তিনি নিয়ত করেছিলেন, যে নবীর জন্য আজান দিতাম তিনি যেহেতু নেই তাই আর আজান দেব না। বেলালের এমনই ছিল নবী প্রেম। ষোল হিজরিতে ওমর (রা.) বাইতুল মুকাদ্দাস সফরে তাকে আজান দেয়ার অনুরোধ করলে, তিনি আজান দেন। তাতে উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যান। হজরত ওমরসহ অন্যান্য সাহাবিরা নীরবে কাঁদেন। বেলালের মরমি আজান আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি, হবেও না। কবির ভাষায়- ‘আজানের সুর আছে, বেলালের সেই রুহ নেই।’
নবীর প্রতি ভালোবাসা
নবীপ্রেমী এই সাহাবি নবীর বিরহ সইতে না পেরে সিরিয়ায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। দীর্ঘদিন পরে একদিন নবীজিকে স্বপ্নে দেখেন। নবী তাকে বলছেন, বেলাল! এমন নিরস জীবন আর কতকাল? আমার জেয়ারতের সময় কি এখনো হয়নি? নবীপ্রেমের ক্ষত তাজা হলে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। নবীর রওজার সামনে এলে জবাই করা মোরগের মতো ছটফট করতে থাকেন। এতটাই ছিল তার নবীপ্রেম, যা এ যুগে আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
শত প্রয়োজন ও দরিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও হাতে ভালো কিছু এলে তার একাংশ রাসুলকে হাদিয়া দিতেন। একবার উৎকৃষ্ট মানের কিছু খেজুর রাসুলের কাছে নিয়ে এলে তিনি বললেন, বেলাল! এগুলো কোথায় পেলে? তিনি বললেন, আপনাকে হাদিয়া দেয়ার জন্য আমার দু’সা নিম্নমানের খেজুর দিয়ে এই এক’সা ক্রয় করেছি। রাসুল বললেন, এমনটা আর কর না। কারণ এটাও এক ধরনের সুদ। যদি এমনটা করাই লাগে তাহলে আগে তোমারটা বিক্রি করে, পরে সেই মূল্য দ্বারা ভালোটা ক্রয় করবে। (আসহাবে রাসুলের জীবন কথা : ১ : ১১৫)।
তার ইবাদত
বেলাল (রা.) যেহেতু মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন, তাই অধিকাংশ সময় তার ইবাদতেই কাটত। একবার রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কোন কাজটির জন্য বেশি সাওয়াবের আশা কর? তিনি বলেন, আমি তো এমন কোনো ভালো কাজ করি না, তবে প্রত্যেক ওজুর পরে দু’রাকাত নামাজ আদায় করি।
বিনয়ী আখলাক
বেলাল (রা.) একজন অহংকারহীন, বিনয়ী ছিলেন। কেউ তার গুণের কথা জানতে চাইলে তিনি বলতেন, আমি একজন হাবশি, কাল পর্যন্ত যে একজন দাস ছিল। সততা, পাপমুক্ততা ও বিশ্বস্ততা ছিল তার চরিত্র। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) কাবায় প্রবেশ করলে বেলাল তার সঙ্গেই ছিলেন। রাসুল (সা.) বেলালকে কাবার ছাদে উঠে আজান দিতে বললে, তিনি আজান দেন। মূর্তিমুক্ত কাবায় প্রথম আজান দেয়ার ভাগ্য অর্জন করেন বেলাল একমাত্র ঈমানের কারণে। (সহি ইবনে হিব্বান : ৩২০৪)।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ
বেলাল (রা.) বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে তিনি বদরের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি। রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা বদরি সাহাবিদের ক্ষমা করেছেন। (তারিখে দেমাস্ক : ৯ : ৮১)।
তার মর্যাদা
একদিন নবী (সা.) বেলালকে বললেন, কীসের বদৌলতে তুমি আমার আগেই জান্নাতে চলে গেলে। গতরাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে তোমার পায়ের খসখস আওয়াজ পেলাম। উত্তরে বেলাল বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কোনো গোনাহ করলে সঙ্গে সঙ্গে দু’রাকাত নামাজ আদায় করি। আর ওজু চলে গেলে তখনি ওজু করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করি। নবীজি বলেন, এই দুই আমলের কারণেই তোমার এই মর্যাদা। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ২১ : ৮৩, মুসনাদে আহমাদ: ২৩২৪)।
জীবন থেকে শিক্ষা
দ্বীনের জন্য, আপন ঈমান বাঁচানোর জন্য কতটুকু ত্যাগ করতে হবে তা হজরত বেলাল (রা.) আমাদের দেখিয়েছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন হাজারো কষ্ট ও যাতনায়, নিপীড়ন আর নির্যাতনে কীভাবে ঈমানকে আগলে রাখতে হয়।
এক আল্লাহর বিশ্বাস অটুট রাখতে হয়। তার ঘটনা আমাদের সব ধরনের কষ্ট ও নির্যাতনে ধৈর্য রাখার উপদেশ দেয়। শিক্ষা দেয়।