মসজিদে নববির খুতবা
নম্রতার ফজিলত ও কল্যাণ
শায়খ খালেদ বিন সুলাইমান আল-মুহান্না
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য ও পূর্ণতা হলো উত্তম চরিত্র। ইসলাম ধর্ম আল্লাহতায়ালা উত্তম চরিত্রের এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তাকে এবাদত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, উত্তম চরিত্র মিজানের পাল্লায় অনেক ভারী হবে এবং এর দ্বারা জান্নাতে মর্যাদা উন্নীত হবে। মুসলমানের অন্যতম একটি গুণ হলো নম্রতা। যা মানুষের কথা কাজ ও আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
এই নম্রতা আল্লাহতায়ালার একটি গুণ। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহ হলেন নম্র তিনি নম্রতাকে পছন্দ করেন। নম্রতার কারণে আল্লাহতায়ালা যত বেশি সওয়াব দেন অন্য কোনো আমলে এত বেশি সওয়াব দেন না। অতএব, যে মোমেন নম্রতার জায়গায় নম্রতা প্রদর্শন করে, সে যেন আল্লাহতায়ালার অসংখ্য গুণাবলির মধ্য থেকে একটি গুণ ধারণ করল। যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণ ধারণ করল, এই গুণ তাকে স্বীয় লাগামের মাধ্যমে তাকে আল্লাহতায়ালা ও তার রহমতের নিকট নিকটবর্তী করে দেবে। আল্লাহতায়ালা তার গুণবাচক গুণাবলি যে ধারণ করে তাকে ভালোবাসেন। ওই গুণকে মানুষের মধ্যে প্রয়োগকারীকেও তিনি ভালোবাসেন। কারণ তিনি হলেন নম্র। ফলে নম্রতা ও নম্র আচরণকারীকে তিনি পছন্দ করেন।
নবীজি (সা.)-এর অন্যতম একটি গুণ ছিল নম্র ব্যবহার করা। যে গুণটি তার রিসালাতের পূর্ণতা, আমানত রক্ষায় ও উম্মতের কল্যাণ কামনায় ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এ কারণেই নবীজির অসংখ্য গুণাবলির মধ্য থেকে এই মহান গুণটির কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহের কারণেই আপনি সাহাবিদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করেছেন। আপনি যদি কর্কশভাষি ও কঠোর হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)। নবীজি (সা.) ছিলেন নম্রতার প্রতীক, কথাবার্তায় সংযমী ও আচরণে বিনয়ী। তার এই বিনয় ও নম্রতার ফল আলেমণ্ডজাহেল, ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সবাই আহরণ করেছে এবং তার নম্রতার শীতল পরশে পুলকিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা যথার্থই বলেছেন, নিশ্চয়ই তিনি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। (সুরা কলাম : ০৪)।
একদা জনৈক ইহুদি নবীজির কাছে এসে এভাবে সালাম দিল, আস সামু আলাইকা ইয়া মুহাম্মদ। এর অর্থ হলো : হে মুহাম্মদ, তোমার মৃত্যু হোক। উত্তরে নবীজি শুধু বললেন, ওয়ালাইকুম। (অর্থাৎ তোমার ওপরও) ইহুদির এই আচরণে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি বলে উঠলেন ওয়া আলাইকুমুস সাম ওয়াল লা’না। অর্থাৎ তোদের উপর মৃত্যু ও অভিসম্পাত বর্ষিত হোক। নবীজি বললেন, শান্ত হও আয়েশা! নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা নম্র, তিনি নম্র আচরণকারীকে পছন্দ করেন। (বোখারি)। স্বয়ং আল্লাহতায়ালাও ছয়দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও নম্রতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি চাইলে এক মুহূর্তেই পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারতেন। তিনি এমনটি করেছেন তার বান্দাদের দৃঢ়তা ও কাজকর্মে নম্রতা শিক্ষা দেয়ার জন্য।
নবীজির দয়া : মোমেনদের প্রতি নবীজির দয়া ও বিনয়ের ঘটনাবলি হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছে হজরত উম্মে কায়স বিনতে মিহসানের সঙ্গে। তিনি নিজেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, একদা তিনি তার এক দুধের শিশুকে নিয়ে নবীজির কাছে এলেন। নবীজি আদর করে তাকে নিজের কোলে বসালেন। শিশুটি তখন নবীজির পবিত্র কোলে পেশাব করে দিল। নবীজি রাগ করেননি। তিনি পানি আনিয়ে পেশাবের উপর ঢেলে দিলেন। তিনি শিশুটির মাকে বুঝতে না দেয়ার জন্য পেশাবকে খুব ভালোভাবে ধুইলেনও না। এই ভেবে, বেশি ধুইলে হয়ত শিশুটির মা এই পেশাবকে গুরুতর কিছু মনে করবে। এই হাদিসে নবীজি (সা.) শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়া ও পেশাব ধোয়ার ঘটনায় নবীজির অনুপম নম্রতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, শৈশবকালে একদা আমি নবীজির সঙ্গে নামাজ পড়লাম। অতঃপর যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হলেন, তখন কিছু বালক তার সামনে পড়ল। তখন তিনি আদর করে প্রত্যেকের চিবুক ছুঁয়ে দিতে লাগলেন। তিনি আমার চিবুকও ছুঁয়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন তার হাত থেকে এমন সুগন্ধির ঘ্রাণ পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল যেন তিনি কোনো সুগন্ধির পাত্র থেকে তার হাতটিকে বের করেছেন। প্রতিটি মানুষই চায়, তার প্রতি নম্র ব্যবহার করা হোক। তাই প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নম্রতা থাকা আবশ্যক। চাই সে সৎ কাজের আদেশদানকারী হোক বা অসৎ কাজ থেকে নিষেধকারী হোক। দ্বীনের দাঈদের মধ্যে নম্রতা থাকা শুধু দরকারই নয়, বরং অতীব জরুরি। এই ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-ই তাদের একমাত্র আদর্শ হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবু রিফাআ আল আদবি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন। একবার আমি রাসুল (রা.)-এর কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি খুতবা দিচ্ছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, একজন দরিদ্র লোক আপনার কাছে দ্বীন শিখতে এসেছে। সে জানে না তার দ্বীন কী? তিনি বলেন, আমার এই কথা শুনে রাসুল (সা.) খুব রেগে আমার কাছে এলেন। তার কাছে একটি তেপায়া আনা হলে তিনি সেখানে বসে আমাকে তালিম দিতে লাগলেন। তালিম শেষে তিনি পুনরায় খুতবা দিতে শুরু করলেন। সুফিয়ান সাওরি বলেন, যেমনিভাবে নেক কাজের আদেশকারী ও অসৎ কাজের নিষেধকারীর জন্য আল্লাহতায়ালার আদেশ নিষেধ জানা আবশ্যক, তেমনিভাবে আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রেও নম্রতা থাকা আবশ্যক। আর নম্রতা হলো দুইটি প্রশংসিত গুণের ফল। যে দুটি গুণকে আল্লাহতায়ালা খুবই ভালোবাসেন। গুণ দুটি হলো- ১. ধৈর্য ও ২. আল্লাহ-মুখিতা। মানুষ যখন এই দুটি গুণ লাভ করবে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সে নম্র বনে যাবে। তখন তার কথাকাজে ও আচরণে নম্রতা প্রকাশ হবে। অতএব, যারা এই দুইটি গুণে গুণান্বিত, তাদের আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। যাদের এই দুইটি গুণ দেয়া হয়েছে, তাদের প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছে। আর যাদের এই দুইটি গুণ দেয়া হয়নি, তাদের আল্লাহতায়ালার কাছে এ দুইটি গুণ চাওয়া উচিত। যেন এই দুটির মাধ্যমে নফস ও শয়তানের সঙ্গে জিহাদ করতে পারে। কারণ নফস ও শয়তান সবসময়ই মানুষকে এই দুইটি গুণের বিপরীত কাজে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। আর তার বিপরীত দুটি অভ্যাস হলো- ১. ক্রোধ ও ২. তাড়াহুড়া। এই দুটি বদ অভ্যাস শুকনা কাঠে প্রজ্জ্বলিত আগুন থেকেও ভয়াবহ ও মারাত্মক।
উভয় জাহানের কল্যাণ : নম্রতার দ্বারা বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের প্রভূত কল্যাণ লাভ হয়। বলা যায় যে, নম্রতার মধ্যেই দুনিয়া আখেরাতের সমস্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেন, যাকে নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে। (আল হাদিস)। এই হাদিসটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সর্বমর্মী বাণী এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ এই হাদিসটি ছোট্ট হলেও এর অর্থ ব্যাপক। মানব জীবনের এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই হাদিসটির নির্দেশনা হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নম্রতা অবলম্বন করতে হবে। চাই সেটা ইবাদত হোক বা মানুষের সঙ্গে চলাফেরাই হোক। যে ব্যক্তির এবাদতে নম্রতা থাকবে না, সে ইবাদতে তাড়াহুড়া করবে এবং ইবাদাতে সময় কম ব্যয় করবে ও দ্রুত শেষ করার মনোভাব পোষণ করবে। ফলে সে ইবাদতে স্বাদ, বরকত, একাগ্রতা ও পূর্ণ সওয়াব থেকে মাহরুম হবে। আর মানুষের সঙ্গে চলাফেরায় যার নম্রতা থাকবে না, মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হবে এবং আস্তে আস্তে মানুষ তার থেকে দূরে সরে যাবে এবং সে মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে সে মানুষের শত্রুতে পরিণত হবে। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো সে মানুষের জুলুমের শিকারও হতে পারে। আর এটাই হলো হাদিসের সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকার অর্থ। সুতরাং রাসুল যথার্থই বলেছেন, যার মধ্যে নম্রতা থাকে, তা তাকে সুসজ্জিত করে, আর নম্রতার অনুপস্থিতি কলুষিত করে। আল্লাহতায়ালা আমাদের নম্র হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।
মসজিদে নববির জুমার খুতবা সংক্ষেপিত অনুবাদ : আবু সালমান ওমর ফারুক