ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহাসত্যের খোঁজে সালমান ফারসি (রা.)

মাহমুদ হাসান ফাহিম
মহাসত্যের খোঁজে সালমান ফারসি (রা.)

আমি সালমান। পারসিক নওজোয়ান। স্পেনের জাঈ নামক গ্রামে জন্ম। বাবা গ্রামের দাহকান-সর্দার। ধন-সম্পদ আর উচ্চ মর্যাদায় তিনি অনন্য। আমাকে খুব ভালোবাসেন তিনি। এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দেন না। মেয়েদের মতো ঘরেই আবদ্ধ করে রাখেন। কোথাও যেতে পারি না। আমরা অগ্নিউপাসক। আগুনের উপাসনাই আমাদের ধর্ম। শুরু করি পৈতৃক ধর্মের সাধনা। উপাসনালয়ে খেদমতের সুযোগ আসে। আগুনের তত্ত্বাবধায়ক পদও পেয়েছি। রাতদিন ২৪ ঘণ্টা উপাসনার আগুন জ্বালিয়ে রাখা আমার দায়িত্বে ছিল।

বাবার অনেক সহায় সম্পত্তি, খেত-খামার। নিজেই সেসবের দেখাশোনা করেন। কোনো কারণে আজ যেতে পারছেন না। আমাকে বললেন, ‘বিশেষ কারণে আমার যাওয়া হচ্ছে না। তুমি যাও, দেখভাল করে এসো।’

খামারের পথ ধরে রওয়ানা হলাম। পথে খ্রিষ্টানদের গীর্জা। পাশ কেটে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম গুন গুন শব্দ। ভেতরে কিছু মানুষ ইবাদতে মশগুল। চলার গতি থেমে গেল। উৎসুক হয়ে ভেতরে ঢুকি। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করি। এটা নাকি তাদের প্রার্থনা। পদ্ধতিটা খুব ভালো। মনে দাগ কাটে। আকৃষ্ট হই। মনে হলো, এ ধর্মই উত্তম। খামারে যাওয়া হয়নি সেদিন। দিনভর গীর্জায় কাটাই। তাদের উপাসনা পদ্ধতি দেখি। মনের উত্তেজনা শুরু। ধর্ম তো এমনই হওয়া উচিত। আগুনের উপাসনা আবার কেমন ধর্ম! কথাবার্তার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করি- ‘এ ধর্মের উৎস কোথায়?’ ‘শামে’ তাদের উত্তর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাড়িতে ফিরি। ‘সারাদিন কী করেছো, কেমন দেখেছ’ বাবার জিজ্ঞাসা। উত্তর দিলাম; ‘খামারে যাওয়ার পথে একটা গীর্জা। দেখলাম কিছু মানুষ ইবাদত করছেন। তাদের ধর্মের রীতিটা খুব ভালো। বেলা ডোবা পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। ওই সব দেখেছি। খামারে যেতে পারিনি।’

উত্তর শুনে বাবা শংকিত হলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘বেটা, ওই ধর্মে কোনো কল্যাণ নেই, অদ্ভুত ধর্ম সেটা। আমাদের ধর্মের সাথে এর তুলনা চলে না। মনে রেখো, পিতৃপুরুষের ধর্ম তা থেকে অনেক গুনে উত্তম।’

আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলি, ‘কসম আল্লাহর, ওদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকে উত্তম।’ বাবার দুশ্চিন্তা। কখন কী করি। আবার ধর্ম ত্যাগ করে বসি কি না। ভাবনা একটাই। সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাকে আর বের হতে দেবেন না। পায়ে বেড়ি লাগিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখলেন। আমি আছি সুযোগের অপেক্ষায়। যেভাবেই হোক শামে যাব। মনে শুধু শামে যাওয়ার স্বপ্ন। গোপনে খ্রিষ্টানদের কাছে সংবাদ পাঠাই ‘শাম অভিমুখী কোনো কাফেলা এলে আমাকে খবর দিবে।’ এরই মধ্য কাফেলা এলো। জানানো হলো ‘কাফেলা এসেছে।’ পালিয়ে বের হলাম। মিলিত হলাম ওই কাফেলার সাথে। শামে পৌঁছে খোঁজখবর নিতে থাকি। লোকদের জিজ্ঞাসা করি। ‘এ ধর্মের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী কে?’ ‘বিশপ, গীর্জার পুরোহিত।’ তারা জবাব দেন।

বিশপের দরজায় হাজির হই। সাক্ষাৎপর্ব শেষে বলি, ‘আমি খ্রিষ্টধর্মে আকৃষ্ট হয়ে জন্মভূমি স্পেন ছেড়ে এসেছি। আপনার সাহচর্যে থাকব। আপনার খেদমত করব। আপনার থেকে খ্রিষ্টধর্ম শিখব এবং পালন করব।’

পুরোহিত বললেন : ‘ভেতরে এসো।’ ভেতরে ঢুকলাম। তার খেদমতে মনোনিবেশ করলাম। কিছুদিন পর দেখি লোকটি অসৎ। তার চারিত্রিক অধঃপতন দেখে তাকে ভীষণ ঘৃণা করতে থাকি। তারপরে অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হন। আমি তারও সাহচর্য গ্রহণ করি। তিনি নেককার। দুনিয়ার প্রতি উদাসীন। আখেরাতের প্রতি অনুরাগী। রাতদিন ইবাদতেই কাটান। এমন নিষ্ঠাবান লোক আগে দেখিনি। তাকে অত্যধিক ভালোবেসে ফেলি। একটা দীর্ঘ সময় তার সান্নিধ্যে কাটাই। তার মরণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাকে জিজ্ঞাসা করি- ‘আপনার পর কার সাহচর্যে যাব? বেটা, শহরে এই সত্যের ধারক কেউ নেই। ইরাকের ‘মাওসেল’ শহরে অমুক নামে একজন আছেন, তার কাছে যাবে।’ তার মৃত্যুর পর মাওসেলে গিয়ে ওই লোককে খুঁজে বের করি। তার কাছে সব কথা খুলে বলি। তিনিও বললেন, ‘আমার কাছে থাকো।’ আমি তার সঙ্গী হই। তার চালচলন, কথাবার্তা সবই ভালো। কিন্তু তারও হায়াত শেষ। অল্প দিন পরেই মারা গেলেন। তার মরণক্ষণ নিকটবর্তী হলে আমাকে উপদেশ দিলেন। ‘বেটা, আমাদের এই সত্যের ওপর অটল আছেন ‘নাসসিবীনে’ অমুক ব্যক্তি। তুমি তার সান্নিধ্যে যাও।’

তাকে কবরস্থ করে ‘নাসসিবীনে’ গেলাম। ওই লোকের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। কাহিনী শুনে তিনি আমাকে তার কাছে রাখলেন। তার সাহচর্য পেলাম। তিনিও নিষ্কলুষ চরিত্রের। আল্লাহর মহিমা, মৃত্যুর ডাক এলো। তিনিও চলে গেলেন। অন্তিমলগ্নে আমাকে রুমের ‘আম্মুরিয়া’ এর একজনে কাছে যেতে বললেন।

তার কাছে গেলাম। সব কথা বললাম। এসব শুনে তিনিও বললেন, ‘আমার কাছে থাকো।’ তিনিও পূর্ব তিনজনের মতো ওপথের অনুসারী। তার কাছে থাকাকালে আমি অনেকগুলো গরু ও ছাগলের মালিক হই। তারও ডাক এলো। বিদায় নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করি, বলুন আমি কী করব, কার কাছে যাব? পরামর্শ দেন। তিনি বললেন, ‘বৎস! ভূ-পৃষ্ঠে এই সত্যের ওপর আর কেউই অবশিষ্ট নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আরবে একজন নবী আসবেন। ইবরাহিমের দ্বীন নতুনভাবে প্রচার-প্রসার করবেন। তিনি জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হবেন। খেজুরের উদ্যানবিশিষ্ট ভূমিতে হিজরত করবেন। দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তার থাকবে। তিনি হাদিয়া দিলে খাবেন; কিন্তু সদকা খাবেন না। তার দু’কাঁধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর থাকবে। পারলে ওই দেশে যেও। তার সান্নিধ্য গ্রহণ করো।’

আম্মুরিয়াতে আছি। আরব দেশে যাব। একবার আরবের ‘কালব’ গোত্রের কিছু ব্যবসায়ী আসে। আমি তাদের সাথে চুক্তি করি, আমাকে আরবে নিয়ে চলো। বিনিময়ে এই গরু-ছাগলগুলো দেব। তারা সম্মত হয়। তাদেরকে অগ্রীম বিনিময় দিই। মদিনা ও শামের মধ্যবর্তী ‘ওয়াদিল-কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমাকে এক ইহুদির কাছে বিক্রি করে দেয়। শুরু হয় দাসত্ব জীবন। বারোজন মনিবের গোলামি করি। শেষমেশ বনি কুরাইজার এক লোক আমাকে নিয়ে আসে ‘ইয়াসরিবে’ (মদিনায়)। এখানে এসে আম্মুরিয়ার বুজুর্গের বক্তব্যে মিল পাই। মনিবের গোলামি করে সময় কাটাই নবীর আগমনের অপেক্ষায়। একদিন খেজুর গাছের মাথায় কাজ করছি। আমার মনিব নিচেই বসা। এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে বলল, ‘আল্লাহ বনি কায়লাকে ধ্বংস করুন। কসম খোদার, কুফায় তারা মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে। সে নিজেকে নবী দাবি করে।’

ওর কথা শুনে আমার গায়ে জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। ভয় হলো, নিচে বসা আমার মনিব। ধপাস করে তার ঘাড়ের ওপর পড়ে যাই কি না। তাড়াতাড়ি নামলাম। তার কাছে জানতে চাইলাম, ভাই! কী বললেন যেন? আবার বলুন তো!’ আমার কথায় মনিব রেগে গেলেন। সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন গালে। ধমক দিয়ে বললেন ‘এর সাথে তোমার কী সম্পর্ক? যাও, তুমি তোমার কাজ করো।’ তখন কিছু বলার সাহস পাইনি।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। আমার সংগৃহীত কিছু খেজুর নিয়ে রওনা হলাম। দেখব, তিনিই ওই প্রতিশ্রুত নবী কি না। তার কাছে পৌঁছলাম। সবিনয়ে বললাম, ‘শুনেছি আপনি একজন পুণ্যবান। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী আছেন। সামান্য কিছু সদকার খেজুর এনেছি। এগুলো আমার জমানো ছিল।’ এ কথা বলে খেজুরগুলো তার দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমরা খাও।’

হাত গুটিয়ে নিলেন তিনি। একটিও মুখে দিলেন না। এক আলামত পেলাম। সেদিন ফিরে এলাম। আবারও কিছু খেজুর জমা করলাম। তিনি কোবা থেকে মদিনায় এলেন। আমি খেজুরগুলো নিয়ে তার কাছে গেলাম। বললাম, ‘দেখেছি আপনি সদকার জিনিস খান না। তাই এবার আপনার জন্য হাদিয়া এনেছি।’ তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের ডাকলেন। সবাই মিলেমিশে খেলেন। এ হলো দ্বিতীয় আলামত। আরেকদিন তিনি ‘বাকি আল গারকাদ’ গোরস্থানে তার এক সঙ্গীকে দাফন করতে এসেছেন। সেখানে গেলাম। গায়ে ঢিলা পোশাক জড়িয়ে বসে আছেন তিনি। আমি সালাম নিবেদন করলাম। আমার দৃষ্টি তার পেছন দিকে ঘুরছে। তৃতীয় আলামতটা দেখার বাকি। বারবার পিঠের দিকে তাকাই। তিনি বুঝতে পেরে চাদরটা সরিয়ে নিলেন। স্বচক্ষে দেখলাম নবুয়তের প্রমাণ। মোহরে নবুয়ত।

একে একে তিনটি আলামতই তার কাছে পেলাম। হ্যাঁ, তিনিই ওই ব্যক্তি। তিনিই প্রতিশ্রুত নবী। সফল আমার জীবন। পূরণ হলো জীবনের একমাত্র আশা। যাকে পাওয়ার জন্য আমার এই দাসত্ব জীবন, তাকে পেয়েছি। স্বার্থক আমার মহাসত্যের খোঁজ। হুমড়ি খেয়ে পড়ি তার পিঠের ওপর। কৃতজ্ঞতা আদায় করে মৃদুভাবে চুমু খাই। চোখের পানিতে বুক ভাসে। এ কান্না দুঃখের নয়, সুখের। এ কান্না আনন্দের। সুখের অনুভূতি হয়ে ঝরে পড়ে অশ্রু। আমাকে কাঁদতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী হলো, কাঁদছ কেন?’

আমি পুরো কাহিনি শোনালাম। তিনি আশ্চর্য হলেন। তার সঙ্গীদের শোনালাম। তারাও অবাক। আর আমি আনন্দিত। বলে বোঝানো সম্ভব নয় সেদিনের অনুভূতি। সন্তানহারা মা সন্তানকে পেয়ে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়, আমার অবস্থা এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ছিল। আমি মহাসত্য পেয়েছি। নবীজির শিষ্য হয়েছি। তার দ্বীনই আমার দ্বীন। তার বিশ্বাসই আমার বিশ্বাস। আমি মুসলমান। তবে গোলাম। দাসত্বের শিকল আমার গলায় ঝুলানো। নবীজি আমার মুক্তির ব্যবস্থা করেন। আমিই পারস্যের মাবাহ। মদিনার সালমান। আমি সালমান ফারসি। (বোখারি, মুসনাদে আহমদ, সিরাতে ইবনে হিশাম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সিয়ারু আলামিন নুবালাসহ বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থ)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত