সাহাবিদের মধ্যকার মতপার্থক্য
আরিফুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহাবিরা ছিলেন নববি ইলমের ধারক ও বাহক। নবীজি (সা.) জীবদ্দশায় তাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য হলে তারা সোজা চলে যেতেন তাঁর কাছে। নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পরও তারা নানা বিষয়ে মতপার্থক্য করেন। সময় যত গড়িয়েছে, স্কলারদের মতপার্থক্য তত বেড়েছে। নতুন নতুন নানান সমস্যায় একেকজন একেকভাবে মতপ্রকাশ করেছেন। মতপার্থক্য কখনও কমেনি, বরং দিনদিন বাড়তেই থাকে।
মতপার্থক্য যখন সীমার মধ্যে থাকে, তখন সেটা সৌন্দর্য। যখন সেটা সীমালঙ্ঘন করে, তখন সেটা বিপর্যয় ডেকে আনে। আমরা এবার দেখব সাহাবিদের মধ্যকার মতপার্থক্য।
নবীজির (সা.) সময়কার সাহাবিদের মতপার্থক্য
বনু কুরাইজার অভিযানের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের বললেন, ‘বনু কুরাইজায় না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ আসরের নামাজ পড়বে না।’ একাংশ সাহাবি বনু কুরাইজায় পৌঁছার আগেই আসরের নামাজের সময় হয়ে গেল। এখন তারা কী করবেন? সাহাবিদের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে গেল। একভাগ বললেন, আমরা রাসুলের কথামতো বনু কুরাইজায় গিয়েই আসরের নামাজ পড়ব। আরেকভাগ বললেন, আমরা এখনই নামাজ পড়ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটা বলতে চাননি যে, সময় হলেও রাস্তায় নামাজ পড়ো না। তাঁর কথার উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যেন দ্রুত বনু কুরাইজায় পৌঁছাই। একদল সাহাবি রাসুলুল্লাহর কথার আক্ষরিক অনুসরণ করেন, আরেকদল সাহাবি রাসুলুল্লাহর কথার প্রায়োগিক, উদ্দেশ্যের অনুসরণ করেন। একদল নামাজ পড়েন রাস্তায়, আরেকদল বনু কুরাইজায় পৌঁছে। রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে দুইদল পুরো বিষয়টি জানান। রাসুলুল্লাহ কোনো দলের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি।’ (বোখারি : ৪১১৯)।
সাহাবিদের মধ্যকার এমন মতপার্থক্যকে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিন্দা করেননি। মানুষের মধ্যে এমন মতপার্থক্য হবে ধরেই নিয়ে রাসুলুল্লাহ একদলকে বলেননি ঠিক কিংবা আরেক দলকে ভুল।
জাতুস সালাসিল যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আমর ইবনুল আস (রা.)। তখন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা ছিল। একরাতে আমর ইবনুল আসের স্বপ্নদোষ হয়; তার গোসল করা ফরজ হয়। অন্যদিকে তিনি মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি, তাকে ফজরের নামাজ পড়াতে হবে। এমন হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে তিনি গোসল করলেন না; ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে যদি ক্ষতি হয় এই আশঙ্কায়। ফরজ গোসল না করেই তিনি ফজরের নামাজের ইমামতি করেন! সাহাবিরা ইমাম সাহেবের এমন ‘শরিয়ত লঙ্ঘন’ দেখে তো ক্ষেপে গেলেন! তারা ফিরে এসে রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে বিচার দিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমর! তুমি নাকি অপবিত্র অবস্থায় তোমার সাথিদের নিয়ে নামাজ পড়েছ?’
আমর ইবনুল আস গোসল না করার কারণ বলতে গিয়ে কোরআনের সুরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতের রেফারেন্স দেন। ‘তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো না।’ একথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) হেসে দিলেন, তাকে আর কিছু বললেন না। (আবু দাউদ : ৩৩৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এবারও যৌক্তিক মতপার্থক্যকে নিন্দা করছেন না। মতপার্থক্যের সুযোগ দিচ্ছেন।
আবু বকর আর উমর (রা.) নানান বিষয়ে দ্বিমত করতেন, তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হতো, এমনকি চরম পর্যায়ের রাগারাগিও। ব্যক্তিগত মতামতের বেলায় তারা দুজন খুব কম সময়ই একমত হতেন। তাদের কাছে কোনো পরামর্শ চাওয়া হলে একজন বলতেন, এই দিকে যান, তো আরেকজন বলতেন, না ওইদিকে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে সাহাবিদের কাছে জানতে চান। আবু বকর (রা.) মত দিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এরা তো আপনারই লোক, আপনারই পরিবার। তাদের জীবিত রাখুন এবং সুযোগ দিন। হয়তোবা আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণ করার তাওফিক দেবেন।’
উমর (রা.) মত দিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এরাই তো আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, এরাই তো আপনাকে অবিশ্বাস করছে। (এখন তাদের কিসের ক্ষমা) সুতরাং, আপনি তাদের শিরচ্ছেদ করুন।’ দুজন সিনিয়র সাহাবি দুই ধরনের মত দিচ্ছেন। একজন বলছেন ক্ষমা করার কথা, তো আরেকজন বলছেন শাস্তি দেবার কথা। কিছুক্ষণ পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ কারও হৃদয়কে এতটা কোমল বানিয়েছেন যা দুধের মতো, আবার কারও হৃদয়কে এতটাই কঠিন বানিয়েছেন যা পাথরের মতো। আবু বকর, তুমি হলে ইবরাহিমের (আ.) মতো, যিনি বলেছিলেন, ‘যে আমার অনুসরণ করেছে নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্য হয়েছে তবে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৬)। আবার আবু বকর, তুমি হলে ইসার (আ.) মতো। যিনি বলেছিলেন, ‘যদি আপনি তাদের শাস্তি প্রদান করেন তবে তারা আপনারই বান্দা, আর তাদের যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়িদা : ১১৮)।
আর উমর, তুমি তো হলে নুহের (আ.) মতো। যিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার রব, জমিনের ওপর কোনো কাফেরকে অবশিষ্ট রাখবেন না।’ (সুরা নুহ : ২৬)। আবার তুমি হলে মুসার (আ.) মতো। যিনি বলেছিলেন, ‘হে আমাদের রব, তাদের ধন-সম্পদ নিশ্চি?হ্ন করে দিন, তাদের অন্তরগুলো কঠোর করে দিন। ফলে তারা ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না যন্ত্রণাদায়ক আজাব দেখে।’ (সুরা ইউনুস : ৮৮)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) দুজন বিশিষ্ট সাহাবির দ্বিমতকে দুজন-দুজন চারজন নবীর সঙ্গে তুলনা করে দেখান, এসব বিষয়ে নবীরাও ভিন্নমত পোষণ করতেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দিদের ছেড়ে দেন। (মুসনাদে আহমাদ : ৩৬৩২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেকটা আবু বকরের (রা.) মত গ্রহণ করেন। কিন্তু, আল্লাহর রায় ছিল ভিন্ন। সেটা উমরের (রা.) সঙ্গে মিলে যায়।
আল্লাহ বলেন, ‘কোনো নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার কাছে যুদ্ধবন্দি থাকবে (এবং পণের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে মুক্ত করবেন) যতক্ষণ না তিনি জমিনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন। তোমরা দুনিয়ার সম্পদ কামনা করছ, অথচ আল্লাহ চাচ্ছেন আখেরাত। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা আনফাল : ৬৭)।
আল্লাহ উমরের (রা.) মত সমর্থন করেন। এই নিয়ে উমর (রা.) আবু বকরকে (রা.) সমালোচনা করেননি, ‘কী আবু বকর, দেখলেন তো আল্লাহ আমার মতের সমর্থন দিয়েছেন।’ বরং, তারা একসঙ্গে থেকেছেন, একে অন্যকে সাহায্য করেছেন। আবার কোনো মতামত চাওয়া হলে দ্বিমত করেছেন, আবার মিলেমিশে চলেছেন।
আরেকবার বনু তামিম গোত্রের এক লোক নির্বাচন করার সময় আবু বকর (রা.) একজনের নাম প্রস্তাব করেন, উমর (রা.) বলেন আরেকজনের নাম। আবু বকর (রা.) রেগে গেলেন। উমরকে (রা.) বললেন, ‘আপনার কাজই হলো আমার বিরোধিতা করা!’ উমর (রা.) নিজেকে ডিফেন্ড করলেন, ‘না, আপনার বিরোধিতা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’ এই নিয়ে দুজন তর্কাতর্কি শুরু করেন। তর্কাতর্কি একসময় চরম পর্যায়ে চলে যায়। তারা দুজন রাসুলের (সা.) সামনে উচু গলায় কথা বলেন। এই নিয়ে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে একটি আয়াত নাজিল করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর আওয়াজের ওপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তাঁর সঙ্গে সেরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না। এ আশঙ্কায় যে তোমাদের সকল আমল-নিষ্ফল হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।’ (সুরা হুজুরাত : ২)।
কোরআনের এই নির্দেশ আসার পর উমর (রা.) আস্তে আস্তে কথা বলা শুরু করেন। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে এমন আস্তে বলতেন যে, দ্বিতীয়বার বলতে হতো। (বোখারি : ৪৮৪৫)।
