মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
পরকালে বিশ্বাস আনে সফলতা
শায়খ ড. বান্দার বালিলা
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কিছু বিষয় সর্বজন স্বীকৃত, সুদৃঢ়, হৃদয়ে গেঁথে নেওয়ার মতো। পরকালে বিশ্বাস তেমনই একটি বিষয়। এটি ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। মানুষের মৃত্যু হবে। হিসাব-নিকাশ হবে। অনুগতরা পুরস্কৃত হবে। অবাধ্যরা শাস্তি পাবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) অনেক সংবাদ দিয়েছেন। সেগুলোর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের নামই হলো পরকালে বিশ্বাস। আল্লাহ বলেন, ‘কেবল পূর্ব বা পশ্চিমাভিমুখী হওয়াটাই পুণ্যের কাজ নয়; বরং পুণ্যের কাজ হলো, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করা।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘যে আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসুলগণ ও পরকালকে অবিশ্বাস করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।’ (সুরা নিসা : ১৩৬)। জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ঈমান হলো আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, কিতাবগুলো, রাসুলগণ, পরকাল ও ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার নিয়তিতে বিশ্বাস করা।’ (মুসলিম : ১)।
মোমিন ও কাফেরের মধ্যে ব্যবধান : পরকালে বিশ্বাসের মাধ্যমেই সত্যিকার মোমিন ও কাফেরের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে যায়। অদৃশ্যে বিশ্বাস তাঁর ব্যাপারে সকল সন্দেহ-সংশয় ছুঁড়ে ফেলাই এর মূলকথা। মোমিন এর প্রতি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস স্থাপন করে। কাফের অবিশ্বাস করে, এ সংক্রান্ত সকল সংবাদকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। আল্লাহ বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত গ্রন্থ। এতে মুত্তাকিদের জন্য পথের দিশা রয়েছে; যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখে।’ (সুরা বাকারা : ১)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘কাফেররা বলে, সে কি তোমাদের এই ভয় দেখায়, তোমরা যখন মারা যাবে, মাটি ও হাড্ডি হয়ে যাবে; আবার তোমাদের জীবিত করা হবে? তোমাদের যে ভয় দেখানো হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ অসম্ভব, অকল্পনীয়। ইহজীবনই সব। আমরা এখানেই মরি, এখানেই বাঁচি। আমরা পুনরুত্থিত হব না।’ (সুরা মোমিনুন : ৩৫-৩৭)। আল্লাহতায়ালা তাদের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘তোমরা কি মনে করেছিলে, তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে? তোমাদের আর আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না? আল্লাহ অতি মহিমাময়, প্রকৃত বাদশা; তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।’ (সুরা মোমিনুন : ১১৫-১১৬)। তিনি আরও বলেন, ‘বলে দাও, আমার রবের শপথ, অবশ্যই তোমাদের পুনর্জীবিত করা হবে। তোমদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করা হবে। এটি আল্লাহর জন্য অতি সহজ।’ (সুরা তাগাবুন : ৭)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা দৃঢ় শপথ করে বলে, আল্লাহ মৃতকে জীবিত করবেন না। অবশ্যই করবেন। এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যা সত্যে পরিণত করার দায়িত্ব আল্লাহর; কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না। মানুষ যে বিষয়ে মতবিরোধ করেছে, সেটি স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য তিনি এটি করবেন। কাফেররা যাতে জানতে পারে, তারা মিথ্যাবাদী ছিল। আমি কোনো কিছু সৃষ্টির ইচ্ছে করলে শুধু বলি, হও। অমনি তা হয়ে যায়।’ (সুরা নাহল : ৩৮-৪০)।
পরকালের কথা ভুলে যাওয়ার পরিণাম : যারা পরকাল ভুলে যায়, আল্লাহ তাদের ভুলে যাবেন। তখন তাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের ভুলে গেলাম, যেমন তোমরা এই দিবসের সম্মুখীন হওয়াকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের ঠিকানা জাহান্নাম। তোমাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা জাসিয়া : ৩৪)। সেটি এমন দিন, যা হৃদয়কে ভীত করে। আক্ষেপের দিন। আফসোসের দিন। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন মানুষ রবের সামনে দণ্ডায়মান হবে।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ৬)। সমাহিত বস্তুকে উত্থিত করা হবে। মনের গোপন কথা প্রকাশ করে দেওয়া হবে। ভূমি প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে। ভূগর্ভ ধারণকৃত বস্তুরাজি উগরে দেবে। নবীজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই ছিলো স্বজাতিকে পরকালের কথা বলা; পরকালের অবস্থা ও ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। পরকালের স্মরণে রয়েছে কল্যাণ, সঠিক পথের দিশা। তা থেকে উদাসীনতা ডেকে আনে অশুভ পরিণাম, ধ্বংস। পরকালের প্রথম ধাপ আরম্ভ হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। এরপর কবর। কবরে নানা পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর। কবরে মোমিন সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে। তাকে সম্মানিত করা হবে। কাফের অক্ষম হবে। তাকে লাঞ্ছিত করা হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে ওহি এসেছে, তোমরা কবরে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। কবরের পরীক্ষা দাজ্জালের পরীক্ষার মতো প্রায়। ফেরেশতা আসবে। জিজ্ঞেস করবে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী জানো? মোমিন হলে বলবে, ইনি মুহাম্মদ; আল্লাহর রাসুল (সা.)। আমাদের কাছে সঠিক পথের দিশা ও সুস্পষ্ট বিবরণ নিয়ে এসেছিলেন। আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছি। ঈমান এনেছি। অনুসরণ করেছি তাঁর। তাকে বলা হবে, আরামে ঘুমাও। আমরা বুঝেছি, তুমি মোমিন ছিলে।’ (বোখারি : ৮৬, মুসলিম : ৯০৫)।
কবরজগৎ ও পরকালের ভয়াবহতা : কবর হবে শান্তি, নয় শাস্তির জায়গা। এরপর পুনরুত্থান, হবে কেয়ামত। আল্লাহ বলেন, ‘কেয়ামত অবশ্যই আসবে, কোনো সন্দেহ নেই। কবরে যারা আছে, আল্লাহ তাদের জীবিত করবেন।’ (সুরা হজ : ৭)। আত্মাগুলো শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বীজের অঙ্কুরোদগমের জন্য ভূমি যেমন বিদীর্ণ হয়, মানুষের বেরিয়ে আসার জন্যও ভূমি সেভাবে বিদীর্ণ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন ভূমি তাদের ওপর থেকে ফেটে যাবে। তারা অতি দ্রুত বেরিয়ে আসবে। এটাই হাশর। এটা আমার জন্য খুবই সহজ।’ (সুরা কাফ : ৪৪)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তুমি ভূমিকে শুষ্করূপে দেখতে পাও। তারপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, অমনি তা আন্দোলিত হয়, উর্বর হয়। যিনি ভূমিতে প্রাণ সঞ্চার করেন, নিশ্চয় তিনি মৃতদেরকেও জীবিত করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশক্তিমান।’ (সুরা হামিম সাজদা : ৩৯)। যখন মানুষ কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে, তখন কেয়ামত হবে। মানুষ রবের দিকে ছুটতে থাকবে খালি পায়ে। খৎনাবিহীন উলঙ্গ থাকবে। সূর্য নিচে নেমে আসবে। লোকেরা ঘামে ডুবে যাবে। আমল ওজন করার জন্য তুলাদণ্ড স্থাপন করা হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যাদের নেক আমলের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফল হবে। যাদের নেক আমলের পাল্লা হালকা হবে, তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তারা সর্বদা জাহান্নামে থাকবে।’ (সুরা মোমিনুন : ১০৪)। সেদিন সবার আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। কেউ তা ডান হাতে গ্রহণ করবে, কেউ বাম হাতে। কাউকে বা গ্রহণ করতে হবে নিজের পৃষ্ঠদেশ থেকে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি সবার আমলনামা তার গলায় সেঁটে দিয়েছি। কেয়ামতের দিন সেটি লিখিতরূপে তার সামনে প্রকাশ করে দেব। সে তা উন্মুক্তরূপে পাবে। (তাকে বলা হবে), নিজের আমলনামা পাঠ করো। আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১৩-১৪)। এরপর আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজীবের হিসাব নেবেন। মোমিনদের আলাদা করে ফেলবেন। তাদের থেকে পাপসমূহের স্বীকারোক্তি নেবেন। তারা সহজে স্বীকার করে নেবে এবং আল্লাহর দয়া-প্রত্যাশী হবে।
আল্লাহর সঙ্গে বিতর্কে জড়ানোর গল্প : কাফের ও মোনাফেকরা কিছু অপরাধ স্বীকার করবে। কিছু অপরাধের ব্যাপারে আল্লাহর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হবে। তিনি তাদের মুখ বন্ধ করে দেবেন। চোখ, কান ও অন্যান্য যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে অপরাধ করেছে, সেগুলোকে ভাষা দান করবেন। তারা সবকিছু স্বীকার করবে। আল্লাহ বলেন, ‘কাফেররা নিজেদের ত্বককে লক্ষ্য করে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে কেনো সাক্ষ্য দিলে? ত্বক বলবে, আল্লাহ আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তিনিই তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। তাঁরই কাছে তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গোনাহ করার সময় চোখ, কান ও ত্বকের সাক্ষী হওয়া থেকে তোমরা নিজেদের লুকাতে সক্ষম ছিলে না। অথচ তোমরা মনে করতে, তোমাদের অনেক কাজই আল্লাহ জানেন না। রবের সম্পর্কে এই ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছো। এখন তারা ধৈর্যধারণ করলেও তাদের ঠিকানা জাহান্নামই। অনুগ্রহ পেতে চাইলে আর তারা অনুগৃহীত হবে না।’ (সুরা হামিম সাজদা : ২১-১৪)। এরপর তাদেরকে জাহান্নামের সম্মুখীন করা হবে। তাদের সবাইকে সমবেত করা হবে তার পাশে। অতঃপর তারা তাতে নিক্ষেপিত হবে।
মোমিনদের জন্য অনিন্দ্য নেয়ামত : মোমিনরা হাউজে কাউসারের জন্য অপেক্ষা করবে। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান এই হাউজ। তার পানি দুধের চেয়েও শুভ্র। মধুর চেয়েও মিষ্টি। তারকারাজির সংখ্যা পরিমাণ তার পাত্র। দৈর্ঘ-প্রস্থে একমাসের পথ তার ব্যাপ্তি। একবার কেউ তার পানি পান করলে কখনোই আর পিপাসার্ত হবে না। এরপর তারা পুলসিরাতের সামনে উপস্থিত হবে। প্রত্যেকের আমলের ওপর নির্ভর করে, সেটি কে কীভাবে পার হবে। নবী-রাসুলগণ সবার আগে পার হবেন। তারাও এর ভয়াবহতা দেখে বলবেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের মুক্তি দিন। হে আল্লাহ! আমাদের মুক্তি দিন।’ এরপর আরেকটি পুল আসবে। এটিও জান্নাত-জাহান্নামের মাঝে স্থাপিত। এখানে একে অন্যের থেকে বদলা নেবে। যখন প্রত্যেকে পরস্পরের থেকে বদলা নেওয়া হয়ে যাবে, সকল মোমিন গোনাহ থেকে পাক-পবিত্র হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘জান্নাতের প্রহরীরা বলবে, আপনাদের প্রতি সালাম। আপনার সুখী থাকুন। আপনারা এতে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য প্রবেশ করুন। জান্নাতিরা বলবে, প্রশংসা আল্লাহর। যিনি নিজ অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। আমাদের এই ভূমির অধিকারী বানিয়েছেন। আমরা জান্নাতের যেকোনো স্থানে নিবাস স্থাপন করতে পারব। সৎকর্মশীলদের জন্য কতই না উত্তম প্রতিদান! তুমি ফেরেশতাদের দেখবে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে আছে। আল্লাহর প্রশংসা করছে। মানুষের মাঝে ন্যায়ানুগ ফয়সালা করে দেওয়া হবে। বলা হবে, সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর।’ (সুরা যুমার : ৭৩-৭৫)।
পরকালে বিশ্বাসে যত সফলতা : পরকালে বিশ্বাস ও তার ভয়াবহতার অনুধাবন মানুষকে সৎকাজে প্রবৃত্ত করে। আত্মা পরিশুদ্ধ করে। চরিত্র সুন্দর করে। ফলে মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয় না। চিরস্থায়ী সৌভাগ্য অর্জনে অলসতা করে না। পার্থিব ভোগ-বিলাসের সামনে অনন্তকালের সুখকে বিসর্জন দেয় না। পার্থিব জীবন ক্ষণিকের। মুহূর্তের কল্পনার মতো এর সমাপ্তি ঘটবে। এটি স্বপ্নের মতো। ক্ষণিকের ছায়া যেন। বুদ্ধিমানরা এর ধোঁকায় পড়ে না। পার্থিব জীবন অতীত হয়ে যাবে। পরকালই ভবিষ্যত। পরকালে ভালো কাজের পাল্লা ভারী করার লক্ষ্যই সর্বোন্নত লক্ষ্য। এর মাধ্যমেই জান্নাত অর্জিত হবে। চূড়ান্ত সফলতা আসবে। পরিণাম প্রশংসিত হবে। আল্লাহর অনুগ্রহে এরপর আর কোনো কষ্ট থাকবে না। সুখের নিবাসে শুধু সুখ আর সুখ; চিরস্থায়ী শান্তি।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর- মুফতি মুইনুল ইসলাম
