মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

মানুষকে কষ্ট দেওয়ার ভয়াবহতা

শায়খ ড. খালেদ বিন সুলাইমান আল মুহান্না

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগৎকে এমন স্বভাবের ওপর সৃষ্টি করেছেন, তারা উপকার লাভ করতে ভালোবাসে ও ক্ষতি দূর করতে চায়। এটা এমন এক প্রকৃতি, যা শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, পশু-পাখিদের মধ্যেও গচ্ছিত রাখা হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন এবং সেই জীবিকার ভেতরে তাদের সব ইন্দ্রিয়ের জন্য আনন্দ ও উপভোগ রেখেছেন। ফলে মানুষের মন সেদিকে ঝুঁকেছে ও হৃদয় সেটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যদি আল্লাহতায়ালা তাদের শুধু এই প্রবৃত্তির ওপর ছেড়ে দিতেন এবং তাদের যে সামর্থ্য দিয়েছেন সেগুলো দিয়েই রেখে দিতেন, তবে তারা নিজেদের খেয়ালখুশির পূর্ণ অনুসারী হয়ে যেত। তখন মানুষের মধ্যে দয়া, সহানুভূতি, মিলন, সহযোগিতা- সব হারিয়ে যেত, বরং একে অপরের ওপর জুলুম করত।

মহান আল্লাহ জানেন, মানুষকে আদেশ-নিষেধ, উৎসাহ-ভীতি প্রদানের পরও শৃঙ্খলাবদ্ধ না করলে তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে না। তাই সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ দণ্ডবিধান রেখেছেন, ন্যায়বিচার করতে আদেশ দিয়েছেন ও ন্যায়কে উৎসাহিত করেছেন, ন্যায়কারীদের জন্য বিপুল পুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন। আবার জুলুমকে হারাম করেছেন, জুলুম থেকে সাবধান করেছেন ও জুলুমকারীদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন।

আল্লাহতায়ালা তাঁর অপার দয়ার ফলেই বান্দাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে তারা তাদের আমলের সওয়াব সংরক্ষণ করবে, যাতে সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে তারা আমলনামায় সেটি পেয়ে যায়। আবার তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন কোন কাজ তাদের আমল নষ্ট করে দেয়, যাতে মানুষ সতর্ক হয়ে তা থেকে বিরত থাকে। এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসুলের আনুগত্য করো, আর তোমাদের কর্ম বিনষ্ট করো না।’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ৩৩)।

কিছু গোনাহ হেলাফেলা করা ভয়াবহ ধ্বংসের কারণ, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতি, আর সর্বনাশের খাদে পতন। অনেক মানুষ আছে যারা আল্লাহর ইবাদতে নিয়মিত পরিশ্রম করে ফরজ-নফল আদায় করে। কিন্তু কেয়ামতের ময়দানে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে, তার বহু আমল বাতাসে উড়ে যাওয়া ধূলার মতো হয়ে যাবে! এমনটা হবে শুধু তার অজ্ঞতা বা গাফিলতির কারণে। সে জানে না বা গুরুত্ব দেয় না এমন গুনাহ তার সৎকর্ম ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে নিঃস্ব লোকদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়, যাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) পরিষ্কার বর্ণনা দিয়েছেন। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি বলতে পার অভাবী লোক কে? তাঁরা বললেন, আমাদের মাঝে যার টাকা কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই সে অভাবী লোক। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত অভাবী লোক সে ব্যক্তি যে কেয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, অমুককে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হক তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম : ৬৪৭৩)।

আল্লাহর কিতাব ও রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ধরনের জুলুমের মূলভিত্তি ব্যাখ্যা করেছেন, যাতে মানুষ এগুলো থেকে সাবধান হতে পারে। সব ধরনের জুলুম মূলত তিনটি ভাগে ঘুরপাক খায়- এক. মানুষের রক্ত বা জীবন, দুই. মানুষের সম্পদ, তিন. মানুষের ইজ্জত-সম্মান। এ বিষয়গুলো নিয়ে শরিয়ত বারবার সতর্ক করেছে, বিস্তারিতভাবে পরিষ্কার করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বিদায়ের কাছাকাছি সময়ে মিনা প্রান্তরে কোরবানি দিবসে ওয়াজের মধ্যে উম্মতকে এ বিষয়ে শক্তভাবে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জত তোমাদের জন্য পরস্পরের কাছে মর্যাদাপূর্ণ। যেমন আজকের এই দিনের মর্যাদা, এই মক্কা শহরের মর্যাদা- তেমনি এগুলোও মর্যাদাপূর্ণ। আমি কি পৌঁছে দিলাম? হে আল্লাহ, সাক্ষী থাকো।’ (মুসলিম : ৪২৭৫)। এই ঘোষণার জন্য এমন এক স্থান, এমন এক দিন ও এমন এক সমাবেশ তিনি বেছে নিয়েছিলেন, যা ছিল সবচেয়ে বড়, যাতে সবার কাছে দলিল-প্রমাণ পৌঁছে যায়, মানুষ পরস্পরের কাছে নিরাপদে থাকতে পারে, তাদের জীবন সুন্দরভাবে চলে, আর তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থা ঠিক হয়। সবচেয়ে বড় জুলুমের একটি হলো, মিথ্যা কসম খেয়ে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শপথ খেয়ে অন্যায়ভাবে মুসলমানের সম্পদ কেড়ে নেয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন ও জাহান্নাম বাধ্যতামূলক করবেন। এক সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, যদি সেটা খুবই সামান্য হয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যদিও সেটা হবে মিসওয়াকের একটি কাঠি।’ (মুসলিম : ২৫০)।

এ জাতীয় জুলুমের মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা। এটা আসলে মানুষের ওপর জুলুম ও অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ ভক্ষণ। এর সাথে যদি মিথ্যা কসম যোগ হয়, যেমন- কোনো পণ্যের গুণমান নিয়ে কসম খেয়ে বাড়িয়ে বলা হয় অথচ বাস্তবে সেটা ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে গোনাহ আরও বড় হয়। ভয়ঙ্কর আর্থিক জুলুম হলো, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা এতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষণ করে; তারা অচিরেই দোজখের জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : ১০)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এতিমদের তাদের ধন-সম্পদ সমর্পণ করবে ও ভালোর সঙ্গে মন্দ বদল করবে না। তোমাদের সম্পদের সঙ্গে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস কর না; নিশ্চয়ই এটা মহাপাপ।’ (সুরা নিসা : ২)।

একটি বড় জুলুম হলো, শ্রমিকদের হক মেরে খাওয়া। যেমন- শ্রমিক বা কর্মচারীর বেতন আটকে রাখা, দেরি করা, টালবাহানা করা, বেতনের থেকে কম দেওয়া বা চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া; কিন্তু তার জন্য অতিরিক্ত মজুরি না দেওয়া। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, কেয়ামতের দিন আমি তিনজনের বিরুদ্ধে নিজেই মামলা করব। তারা হলো, যে লোক আমার নামে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেছে, যে লোক স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার দাম খেয়েছে ও যে লোক শ্রমিককে ভাড়া করে তার কাজ সম্পূর্ণ করিয়ে নিয়েছে; কিন্তু তার মজুরি দেয়নি।’ (বোখারি : ২২৬৯)।

মারাত্মক আর্থিক জুলুমের মধ্যে একটি হলো, যে কর্মচারীকে জাকাত বা সদকা সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে যদি সেখান থেকে নিজের জন্য কোনো অংশ কেটে নেয়। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা যে কেউ অন্যায় পন্থায় কোনো কিছু গ্রহণ করবে, সে কিয়ামতের দিন তা বয়ে নিয়ে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। আমি তোমাদের কাউকে ভালোভাবেই চিনব যে, সে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে উট বহন করে; আর উট আওয়াজ দিতে থাকবে। অথবা গাভী বহন করে, আর সেটা ডাকতে থাকবে। অথবা বকরি বহন করে, আর সেটা ডাকতে থাকবে।’ (বোখারি : ৬৯৭৯)।

সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই মুক্তির চেষ্টা করতে হবে! যতদিন দুনিয়ার সুযোগ আছে, ততদিনে যার ওপর অন্যের হক রয়েছে, সে যেন তা আদায় করে নেয়। এজন্যই নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, তার ভাই-এর পক্ষে তার কাছ থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোন দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার মজলুম ভাইয়ের গোনাহ এনে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ৬৫৩৪)। অতএব, দুনিয়ায় থাকতেই হক ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ আখেরাতে টাকা দিয়ে হক শোধ করা যাবে না, শুধু তাবা করলেই হক মাফ হবে না।

মানুষের ক্ষতি থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের হক। যে মানুষ অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, সে তার রবের কাছে উচ্চ মর্যাদা পায় ও সেরা লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়। এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন মানুষ সবচেয়ে ভালো? তিনি বললেন, যে আল্লাহর পথে নিজের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করে। আর যে নির্জনে বসে তার রবের ইবাদত করে ও মানুষকে তার ক্ষতি থেকে নিরাপদ রাখে।’ আরেকবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেরা আমল কোনটি? তিনি অনেক আমল উল্লেখ করলেন। এর মধ্যে এটাও ছিল যে, ‘মানুষের ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এটাও তোমার নিজের পক্ষ থেকে তোমার জন্য একটি সদকা।’

 

(১৩-০৩-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ০৫-০৯-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস- আবদুল কাইয়ুম শেখ)