মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা
গাফিলতির পরিণতি ও মুক্তির পথ
শায়খ ড. আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমান আল বুআইজান
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের রিপু মন্দ কাজের দিকে টানে। তা খারাপ প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনা ও ভোগ-বিলাসের দিকে ঝুঁকতে চায়। ভালো কাজ করতে আলসেমি করে, ইবাদত ও সৎকর্মে পিছিয়ে থাকে। মানুষের মন বারবার বদলায়, পরিস্থিতি ও ঘটনার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। তাই সবসময় দরকার হয় এর যত্ন, নজরদারি, শিক্ষা, শুদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে ও প্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সুরা নাজিয়াত : ৪০-৪১)।
হৃদয়ও খুব দ্রুত বদলায়, ঘনঘন পরিবর্তিত হয়। মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.) বলতেন, ‘আমি কারও ব্যাপারে ভালো বা মন্দ কিছু বলি না, যতক্ষণ না দেখি তার শেষ পরিণতি কী হয়। কারণ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কেক বলতে শুনেছি, আদম সন্তানের হৃদয় এমনভাবে বদলায়, যেমন ফুটন্ত হাঁড়ির পানি উল্টে-পাল্টে ওঠে।’ (মুসনাদে আহমদ)।
এক কবি বলেছেন, ‘মানুষকে বলা হয় ইনসান, কারণ সে ভুলে যায়। আর হৃদয়কে হৃদয় এ জন্য বলা হয় যে, এটি বারবার বদলায়।’ শাহর ইবনে হাওশাব (রহ.) বলেন, ‘আমি উম্মে সালামা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে মুমিনদের মা, আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনার ঘরে থাকলে সবচেয়ে বেশি কী দোয়া করতেন? তিনি বললেন, তিনি বেশি বেশি বলতেন, হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের ওপর স্থির রাখো।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি এত বেশি এই দোয়া কেন করেন? তিনি বললেন, হে উম্মে সালামা, মানুষের হৃদয় আল্লাহর আঙুল দুটির মাঝে থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে দৃঢ় রাখেন, আর যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করে দেন।’ (তিরমিজি : ৩৫২২)।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর একটি হলো গাফলত বা অলসতা ও উদাসীনতা। এটা এমন এক দুঃখ, যা মানুষের জীবন নষ্ট করে, সময় অপচয় করে, শক্তি নিঃশেষ করে দেয়, হৃদয়কে মৃত করে ফেলে, আর সব ভালো থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। গাফলত হলো আল্লাহকে ভয় না করা, তাঁর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, যেজন্য আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে তা ভুলে যাওয়া, আর আল্লাহর সাক্ষাৎ ও হিসাবের দিনের জন্য প্রস্তুতি না নেওয়া। গাফলত মানে দায়িত্বহীনতা, অলসতা ও উদাসীনতা। এর ফলে মানুষের সামর্থ্য নষ্ট হয়, সময় বরবাদ হয় ও জীবন শেষ হয়ে যায়- এমন কাজে যার কোনো উপকার নেই। গাফলত এক ভয়াবহ বিপদ, যা মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, নেকির পথ থেকে বিচ্যুত করে ও পাপের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। তখন মানুষ তার চারপাশে বিপদ বা শাস্তি এলেও পরোয়া করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার বহু নিদর্শন সম্বন্ধে গাফিল।’ (সুরা ইউনুস : ৯২)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। এরা পার্থিব জীবনের বাহ্য দিক সম্পর্কে অবগত, আর আখেরাত সম্বন্ধে এরা গাফিল। এরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? আল্লাহ আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও এদের অন্তর্র্বর্তী সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাতে অবিশ্বাসী।’ (সুরা রুম : ৬-৮)।
শয়তান মানুষকে গাফলতের মধ্যে ফেলে ধীরে ধীরে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রথমে সুন্নত ছাড়াতে শেখায়, তারপর নফল ইবাদতে আলসেমি করায়, এরপর ফরজ বাদ দিতে বাধ্য করে, পরে মানুষকে অপছন্দনীয় কাজে অভ্যস্ত করে ফেলে, আর শেষে হারাম কাজে নামিয়ে দেয়। এমনকি ছোট ছোট গুনাহকেও মানুষ তুচ্ছ ভাবতে থাকে, আর শেষে বড় ধ্বংসাত্মক পাপে ডুবে যায়। অতএব, হে আল্লাহর বান্দারা, গাফিলতিকে দূর করার ব্যাপারে সতর্ক হও, এর কাছে আত্মসমর্পণ করে গা ভাসিয়ে দিও না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে বিনীত ও সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে সকালে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে আর তুমি গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ (সুরা আরাফ : ২০৫)। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ, আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে হৃদয়গুলোকে জীবিত রাখো, গাফিলতি ও কঠোরতা থেকে বেঁচে চল, আর আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাক।
শয়তানের কুমন্ত্রণা মানুষের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা। ভুলে যাওয়া কিংবা অলসতা মানুষের দুর্বলতার কারণে হতে পারে। কিন্তু যদি কেউ বারবার এতে ডুবে থাকে ও অবহেলা করতে থাকে, তবে তা বড় বিপদ। তাই কোনো মুমিন যদি গাফলতের মধ্যে পড়ে যায়, তবে তাকে দ্রুত আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে, তাওবা করতে হবে, শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে ও তার কুমন্ত্রণা প্রতিহত করতে হবে। হৃদয়কে জাগাতে হবে, শয়তান যেন পুরোপুরি দখল করতে না পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর শরণ নেবে; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যারা তাকওয়ার অধিকারী হয় তাদের শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে, আর তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়। তাদের সঙ্গী-সাথিরা তাদেরকে ভ্রান্তির দিকে টেনে নেয় এবং এ বিষয়ে তারা কোন ত্রুটি করে না।’ (সুরা আরাফ : ২০০-২০২)।
গাফলত মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর একটি। যদি এটি হৃদয়ে জমে যায়, তবে তা মানুষের দুনিয়া ও আখেরাত নষ্ট করে দেয়। গাফলত হলো অন্তরের চোখ ঢেকে দেয়ার পর্দা, সত্য থেকে দূরে রাখার আবরণ ও জীবনের সময় নষ্ট হওয়ার মূল কারণ। তুমি গাফিল মানুষকে দেখবে, তারা তাওবা পরে করার সিদ্ধান্ত নেয়, ইবাদত পিছিয়ে দেয়, ভাবে এখনও অনেক সময় আছে। অথচ সময় ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে এবং সুযোগগুলো আর ফিরে আসছে না। গাফলতের অন্যতম কারণ হলো আল্লাহর ভয় না থাকা এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি না নেওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না ও পার্থিব জীবনেই সন্তুষ্ট আর এতেই পরিতৃপ্ত থাকে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলি সম্পর্কে গাফিল। এদেরই আবাস দোজখ, এদের কৃতকর্মের জন্যে।’ (সুরা ইউনুস : ৭-৮)।
আরেকটি কারণ হলো সময় নষ্ট করা। অবসর সময়কে মূল্য না দেওয়া। তখন মানুষ উদ্দেশ্যহীন হয়ে বেঁচে থাকে, আর জীবন বৃথা যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত আছে, যেগুলোর ব্যাপারে অনেক মানুষ প্রতারিত হয়: সুস্থতা ও অবসর।’ (বোখারি : ৬৪১২)। বিশ্বনবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিনে কোনো বান্দার পা সরবে না, যতক্ষণ না তাকে জিজ্ঞেস করা হবে- তার জীবন কোথায় কাটাল, তার যৌবন কোথায় শেষ করল।’ (তিরমিজি : ২৪১৬)।
আরেকটি বড় কারণ হলো গাফিল ও উদাসীন লোকদের সঙ্গে মেলামেশা। কারণ মানুষ তার সঙ্গীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন, ‘তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে এদেরই সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় ডাকে এদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে এদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। তুমি তার আনুগত্য করো না যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সুরা কাহফ : ২৮)।
আমাদের এ যুগে গাফলতের অন্যতম বড় দরজা হলো, মোবাইল-ডিভাইস, টিভি ও স্ক্রিনের ব্যস্ততা। মানুষ এগুলোর মাধ্যমে সময় নষ্ট করে, বিভ্রান্তিকর বিষয় দেখে, গোনাহের দৃশ্য ও লোভনীয় বিষয়গুলোতে ডুবে যায়। এর কারণে বহু হৃদয় অন্ধকারে ঢেকে যায়, বহু সময় অপচয় হয়। অনেকে কোরআন পড়ার সময় পায় না, জ্ঞানচর্চার আসরে যেতে পারে না, এমনকি একান্তে আল্লাহর কাছে কান্না করারও সময় পায় না। অথচ আল্লাহ তাআলা আমাদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন; কিন্তু এরা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। যখনই এদের কাছে এদের প্রতিপালকের কোন নূতন উপদেশ আসে এরা তা শ্রবণ করে কৌতুকচ্ছলে, এদের অন্তর থাকে অমনোযোগী।’ (সুরা আম্বিয়া : ১-৩)।
গাফলত থেকে বাঁচার সেরা উপায় হলো, আল্লাহকে ভয় করা, আন্তরিকভাবে তার দিকে ফিরে আসা, তওবা করা, গোনাহ ছাড়ানো, মানুষের হক আদায় করা, দোয়া ও ইবাদতে চেষ্টা করা, নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও হিসাব-নিকাশ করা। বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব নেয় ও মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। আর দুর্বল সেই ব্যক্তি, যে নিজের প্রবৃত্তির পেছনে ছুটে বেড়ায় আর আল্লাহর কাছ থেকে শুধু আশা করে।’ তাই তোমরা নিজের হিসাব নাও, এর আগেই যে আল্লাহ তোমাদের হিসাব নেবেন। নিজের জীবনকে যাচাই করো, কারণ আগামীকাল হিসাবের দিনে তা সহজ হবে, যদি আজকেই নিজেকে হিসাবের আওতায় আনো। আর সেই দিনের জন্য প্রস্তুত হও, যেদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সেই দিন উপস্থিত করা হবে তোমাদের, তোমাদের কিছুই গোপন থাকবে না।’ (সুরা হাক্কাহ : ১৮)।
(০৪-০৪-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৬-০৯-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস - আবদুল কাইয়ুম শেখ)
