নবীপ্রেমের গল্প

মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শামের নীলাভ আকাশের নিচে এক নিঃসঙ্গ প্রেমিক বসে আছেন। তার চোখে বিচ্ছেদের অশ্রু টলমল করছে, আর হৃদয়ে এখনও জ্বলছে এক শিখা- প্রেমের, ভক্তির, ভালোবাসার। তিনি হযরত বেলাল ইবন রাবাহ (রা.) প্রিয় নবীজির (সা.) মুয়াজ্জিন। প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের পর মদিনায় থাকতে পারেননি তিনি। প্রতিটি মসজিদের মিনার, প্রতিটি রাস্তায় প্রিয় নবীজি (সা.)-এর স্মৃতি জ্বলজ্বল করছিল। তার পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি চলে এসেছিলেন দূরবর্তী শামে। কিন্তু আজকের রাতটি ছিল অন্যরকম। গভীর রাতে তিনি ঘুমের মধ্যে দেখলেন এক অতি পরিচিত, প্রিয় মুখ। ‘হে বেলাল, এ কী অকৃতজ্ঞতা? হে বেলাল, এখনও কি সময় হয়নি যে তুমি আমার সাক্ষাৎ করবে?’

তিনি চমকে উঠলেন। দেহ শিহরিত হলো। নবীজি (সা.) স্বপ্নে এসেছেন! বেলালের চোখে অশ্রু টলমল করছিল। তার স্ত্রী পাশে বসে ছিলেন। বলরেন, ‘হে বেলাল, আপনি এত অস্থির কেন?

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে স্মরণ করেছেন! আমি আর এখানে থাকতে পারি না। আমি মদিনা যাচ্ছি!’

তিনি সঙ্গে সঙ্গে উট প্রস্তুত করলেন। তীব্র বাতাসের মাঝে, মরু পথ ধরে ছুটে চললেন। তার হৃদয়ে ছিল শুধু এক নাম- মুহাম্মাদ (সা.)।

দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পথ চলার পর অবশেষে সেই পবিত্র নগরীতে পৌঁছালেন, যেখান থেকে তিনি একদিন বিদায় নিয়েছিলেন। মদিনায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে যেন বদলে গেল এক গন্ধ। প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুবাস যেন এখনো মদিনার বাতাসে মিশে আছে। তিনি ধীর পায়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন। সামনে ছিল সেই রওজায়ে আতহার, যেখানে শায়িত তাঁর প্রিয়তম রাসুল (সা.)।

এগিয়ে গেলেন, কণ্ঠ কাঁপছিল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- বাংলা উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ, আসসালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ। বাংলা অর্থ : আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে আল্লাহর প্রিয়জন!

তিনি বসে পড়লেন। কাঁদতে লাগলেন। মাটি স্পর্শ করলেন। যেন এই মাটি তাকে জীবনের সকল কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। এদিকে মদিনায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল- হজরত বেলাল ইবন রাবাহ (রা.) ফিরে এসেছেন!

হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) ছুটে এলেন। প্রিয় নবীজি (সা.) এই দুই প্রিয় দৌহিত্র তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘হে বিলাল, আমরা সেই আজান শুনতে চাই, যা আপনি আমাদের নানা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় দিতেন!’

হজরত বেলাল ইবন রাবাহ (রা.) থমকে গেলেন। এতদিন তিনি আজান দেননি, কারণ তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ তাকে প্রিয় রাসুল (সা.)-এর স্মৃতি মনে করিয়ে দিত। কিন্তু তিনি এই আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলেন না। মিনারের চূড়ায় উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো সেই পরিচিত ধ্বনি- আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।

মদিনার বাতাসে যেন আবার ফিরে এলো সেই পুরোনো দিনের সুর। গৃহের দরজাগুলো খুলে গেল। সবাই বেরিয়ে এলো। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বললে মানুষ আরও বেরিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু যখন তিনি উচ্চারণ করলেন- আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ- তার কণ্ঠ আটকে গেল। তার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি আর বলতে পারলেন না।

পুরো মদিনায় হাহাকার উঠল। নারীরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, আর বললেন, ‘প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.) কি ফিরে এসেছেন?’ সে দিন মদিনায় এত কান্না হয়েছিল, যা প্রিয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর আর কখনও দেখা যায়নি।

হজরত বেলাল ইবন রাবাহ (রা.) তখন মৃত্যুশয্যায়। তার স্ত্রী তাকে দেখে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘ওহ! কী দুঃখের দিন!’ কিন্তু হজরত বেলাল ইবন রাবাহ (রা.) মৃদু হেসে বললেন, ‘আহ্! কী আনন্দের দিন! কাল আমি মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে মিলিত হব!’

তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল, মনে হলো- শিমুল গাছের শেষ ফুলটি ঝরে পড়ল। হৃদয়ে ছিল শুধু এক প্রেম- প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি।