অধুনা যে কোনো বয়সের মানুষের শরীর ঠিক রাখতে হলে ব্যায়ামের বিকল্প নেই। সব ব্যায়াম সব বয়সের জন্য উপযোগী নয় এবং সব ব্যায়াম করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম, যা সব বয়সের জন্য মানানসই। সহজে করা যায়। হাঁটার উপকারিতাও অনেক। এর চেয়ে সহজ ব্যায়াম আর নেই। সব বয়সের মানুষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এ ব্যায়াম কম খরচে শরীর ভালো রাখা যায়। ঘরে-বাইরে যে কোনো জায়গায় করা যায়। ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী এর তীব্রতা বাড়ানো-কমানো যায়। উপযুক্ত পোশাক এবং এক জোড়া ভালো জুতা ছাড়া কোনো অতিরিক্ত খরচের প্রয়োজন পড়ে না।
ডায়াবেটিস রোগীর উপকার
ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাট-বাজারে কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা। অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে ওঠা বা নামার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন বা সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট হাঁটলে এবং শরীরে ওজন সাত শতাংশ কমালে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা কমে প্রায় ৫৮ ভাগ। যদি ডায়াবেটিস হয়েই থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও হাঁটা বিশেষ কার্যকর। হাঁটাহাঁটি করলে শরীরের পেশিতে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে এবং রক্তের সুগার কমে, ওষুধ কম লাগে।
স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোকের অন্যতম একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হচ্ছে অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। হাঁটাচলা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের মেদ কমে যায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে আসে। দৈনিক এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন হাঁটার মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
অনেকেই শরীরের ওজন কমাতে শুধু ডায়েটিং করেন। কিন্তু হাঁটাহাঁটি না করে বা অলস জীবনযাপন করে শুধু ডায়েট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ওজন কমানো সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি ওজন নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল চাবিকাঠি স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার এবং নিয়মিত হাঁটাচলা।
হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা
নিয়মিত হাঁটার ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হৃদযন্ত্র স্বল্প চেষ্টায় শরীরে বেশি পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এবং ধমনির ওপরও চাপ কম পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। হাঁটার মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত হাঁটলে শরীরে জমে থাকা মেদ কমে। রক্তে মন্দ কোলেস্টেরল বা লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন কমে যায়। এ মন্দ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা ধমনির গায়ে জমে হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যারা সপ্তাহে অন্তত তিন ঘণ্টা অথবা দৈনিক আধা ঘণ্টা করে হাঁটেন, তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম। হাঁটার ফলে ভালো কোলেস্টেরল বা হাই ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন বাড়ে। ফলে রক্তনালিতে ব¬ক সহজেই হয় না। রক্তনালির দেওয়াল শক্ত হয়ে যায় না। তাই হৃদরোগের কারণে মৃত্যুঝুঁকি কমে প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও।
হাঁটা ও কর্মক্ষমতা
হাঁটার সময় হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এবং রক্ত সরবরাহ বাড়ে। এগুলো বেশি কর্মক্ষম থাকে। হাঁটার ফলে পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে ফলে পেশির শক্তি বাড়ে। শরীরের ওজন কমে। শরীর থাকে ফিট। নিজেকে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। সার্বিকভাবে শরীরের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাঁটাচলা অনেকটা উচ্চ রক্তচাপরোধী ওষুধের মতো কাজ করে। হাঁটার ফলে উচ্চরক্তচাপ হয় না এবং আগে থেকেই উচ্চরক্তচাপ থাকলে তা কমিয়ে রাখে।
টিপস
* হাঁটা শুরু করার প্রথম ৫-১০ মিনিট এবং শেষের ৫-১০ মিনিট আস্তে হেঁটে শরীরকে ওয়ার্ম আপ এবং ওয়ার্ম ডাউন করুন।
* হাঁটার আগে এবং পরে একটু পানি পান করুন।
* খাওয়ার পরপরই হাঁটবেন না। ৪৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
* দুপুরে রোদে হাঁটবেন না। সকাল বা বিকালের একটি সময় বেছে নিন।
* হাঁটা শেষ করে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে কিছু খেয়ে নিন।
* হাঁটায় উপকারিতা পেতে অবশ্যই সপ্তাহে অন্তত তিন বা চার দিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে হাঁটতে হবে। হাঁটতে হবে যথেষ্ট দ্রুত, যেন শরীরটা একটু ঘামে।
হাড়ের ক্ষয়রোগ রোধে
পোস্ট মেনপোজাল (রজঃনিবৃত্তি-পরবর্তী) নারী এবং বয়স্ক পুরুষদের সাধারণ রোগ হচ্ছে অষ্টিও পোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ। এ রোগে হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। সামান্য আঘাত বা অল্প উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে যেতে পারে। নিয়মিত হাঁটাচলা এ ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, রজঃনিবৃত্তি-পরবর্তী বয়সে যেসব নারী প্রতিদিন অন্তত এক মাইল হাঁটেন, তাদের হাড়ের ঘনত্ব কম হাঁটা নারীদের তুলনায় বেশি। হাঁটার ফলে যেমন হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা হ্রাস পায়, তেমনি আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগ হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
হৃদরোগ বিভাগ, মুন্নু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল