শরীরের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে হাঁটুর কাজ বা গতি সবচেয়ে বেশি হওয়ায়, এর ইনজুরি বা আঘাতও বেশি দেখা যায়। হাঁটু যদিও একটি স্বাভাবিক অঙ্গ মনে হয়; কিন্তু হাঁটু এমন একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ জোড়া যা বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, দৌড়াতে, ওপরে উঠতে এবং নামতে একান্ত প্রয়োজন। আবার হাঁটু শরীরের বড় ও ওজন বহনকারী জোড়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। হাঁটুর জোড়া তিন হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। হাঁটুতে চারটি প্রধান লিগামেন্ট ও দুটি মেনিসকাস (তরুণাস্থি) থাকে। লিগামেন্ট হলো ফাইব্রাস টিস্যু যা এক হাড়কে অন্য হাড়ের সঙ্গে যুক্ত করে, জোড়ায় শক্তি প্রদান করে, হাড়ের নড়াচড়ায় সহায়তা করে এবং জোড়ার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। মেনিসকাস শরীরের ওজন সমভাবে উরুর হাড় থেকে পায়ের হাড়ে সরবরাহ করে, হাড়ের প্রয়োজনীয় নড়াচড়ায় সাহায্য করে এবং জোড়ার দৃঢ় অবস্থা বজায় রাখে। আঘাত জোড়াকে বিভিন্ন স্তরে আক্রান্ত করে। আঘাতের তীব্রতা অনুসারে জোড়ার আবরণ, লিগামেন্ট, হাড়, তরুণাস্থি বা মেনিসকাস এবং পেশি আক্রান্ত হয়। ইনজুরিতে লিগামেন্ট বিস্তৃত হতে পারে এবং আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিড়ে যেতে পারে। আঘাতের জন্য মেনিসকাসের বিভিন্ন ধরনের ইনজুরি ছাড়াও মেনিসকাস আংশিক সম্পূর্ণ টিয়ার হতে পারে। আঘাতের তীব্রতার প্রকারভেদে জোড়ার হাড় ভাঙতে পারে এবং জোড়ার স্থানচ্যুতি হতে পারে।
কারণ
১. হঠাৎ জোড়ায় সরাসরি আঘাত।
২. গাড়ি বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
৩. ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, কাবাডি ও হাডুডু খেলোয়াড়রা হাঁটুতে চাপের কারণে লিগামেন্ট ইনজুরিতে ভোগে।
৪. মই থেকে পড়ে গেলে, রিকশা থেকে পড়ে গেলে, ওপর থেকে পড়ে গেলে বা ওপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লে।
৫. গর্তে পড়ে গেলে।
৬. সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক স্টেপ ভুল করলে।
৭. হাঁটুর বাইরে পার্শ্বে সরাসরি আঘাত।
লিগামেন্ট ইনজুরির লক্ষণগুলো
প্রথমে তীব্র ব্যথা, পরে আস্তে আস্তে কমে আসে।
হাড় ভাঙলে বা জোড়া স্থানচ্যুত হলে তীব্র ব্যথা হবে এবং জোড়ার অস্বাভাবিক আকৃতি হবে।
ব্যথা হাঁটুর বাইরের পার্শ্বে এবং পেছনে অনুভূতি হবে।
হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়।
আঘাতের প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যেই হাঁটু ফুলে যায়।
ফুলা ও ব্যথার জন্য হাঁটু নড়াচড়া করা যায় না।
দাঁড়াতে বা হাঁটতে চেষ্টা করলে মনে হবে হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে।
আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ‘পপ’ বা ‘ক্র্যাক’ শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারবে।
বেশিক্ষণ বসলে হাঁটু সোজা করতে কষ্ট হয়।
অনেক সময় হাঁটু আঁটকে যায়, রোগী হাঁটুকে নড়াচাড়া করিয়ে সোজা করে।
উঁচু-নিচু জায়গাগায় হাঁটা যায় না, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয়।
হাঁটু অস্থিতিশীল বা ছুটে বা ঘুরে যাচ্ছে, এরকম মনে হবে।
দীর্ঘদিন যাবৎ লিগামেন্ট ইনজুরি থাকলে হাঁটুর পেশি শুকিয়ে যায় এবং হাঁটুতে শক্তি কমে যায়।
প্রাথমিক করণীয়
হাঁটুকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
বরফের টুকরা টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি প্লাস্টিকের বেগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে আসবে।
হাঁটুতে ইলাসটো কমপ্রেসন ব্যবহারে ফুলা ও ব্যথা ও ফুলা কমে আসে।
হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটুকে হার্টের লেবেল থেকে উঁচুতে রাখলে ফুলা কম হবে।
এনালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন।
হাড় ভাঙলে বা জোড়া স্থানচ্যুতি হলে সিপ্লন্ট লাগিয়ে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম এমন চিকিৎসাকের কাছে বা সেন্টারে রোগী পাঠাতে হবে।
চিকিৎসা
প্রাথামিক চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা ও ফুলা সেরে উঠার পর, হাঁটুর বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে কী কী লিগামেন্ট ইনজুরি হয়েছে এবং এর তীব্রতা নির্ণয় করা যায়। কখনও কখনও এক্স-রে ও এমআরআইর সাহায্য নিতে হয়। জোড়া স্থানচ্যুতি বা হাড় ভাঙলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রুত প্রদান করতে হবে। হাঁটুর লিগামেন্ট বিস্তৃত (স্ট্রেস) ইনজুরি ও মেনিসকাসের ক্ষুদ্র ইনজুরি হলে প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয়। তবে কিছু কিছু আংশিক টিয়ারের ক্ষেত্রে হাঁটুর পেশির ব্যায়াম ও দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে সুস্থ থাকা যায়। ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরি হলে নতুন করে লিগামেন্ট তৈরি করতে হয়। এর মধ্যে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট তৈরি করা জরুরি কারণ লিগামেন্ট না থাকলে হাঁটুতে তাড়াতাড়ি অস্টিওঅথ্রাইটিস হয়ে জোড়া নষ্ট হবে। বর্তমানে হাঁটুর বাইরে থেকে টেনডন দিয়ে ছোট দুটি ছিদ্র দিয়ে আর্থোস্কোপ যন্ত্র হাঁটুতে প্রবেশ করিয়ে নতুন লিগামেন্ট তৈরি করা হয়। বড় ধরনের মেনিসকাস ইনজুরি হলে রিপেয়ার বা রিমোভ করা হয়। আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি বা শল্য চিকিৎসার পর নিয়মিত ও পরিমিত পরিচর্যার (রিহেবিলিটেশন) মাধ্যমে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে।
ডা. জি এম জাহাঙ্গীর হোসেন
অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ
হাড় ও জোড়া বিশেষজ্ঞ এবং আর্থ্রোস্কোপিক সার্জন
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও
পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), ঢাকা
চেম্বার : বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল লিঃ.
শ্যামলী (মিরপুর রোড)
ঢাকা-১২০৭
হটলাইন-১০৬৩৩,
মোবা:-০১৭৪৬৬০০৫৮২