ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সেরিব্রাল পালসি

সেরিব্রাল পালসি

সেরিব্রাল পালসি। এটা কোনো রোগ নয়, এটা হচ্ছে শারীরিক গঠনগত সমস্যা। মূলত জন্মের আগে মস্তিষ্কের আঘাতজনিত কারণে বা রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটার ফলে সেরিব্রাল পালসি হয়ে থাকে। ‘সেরিব্রাল’ মানে ব্রেন বা মস্তিষ্ক আর ‘পালসি’ মানে হচ্ছে প্যারালাইসিস বা অবশভাব। অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্যারালাইসিস বা অবশগত ভাবের কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। বিশেষ করে এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ঠিকমতো হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারে না, বসতে পারে না কিংবা হাঁটতে পারে না এবং কারও কারও ইনটেলেকচুয়াল বা বৌদ্ধিক (অটিজম) সমস্যা থাকতে পারে। এছাড়া খাবার গিলতে এবং কথা বলতে অসুবিধা থাকতে পারে। শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ বোঝা যায় না। সাধারণত শিশুর বয়স ২ থেকে ৩ বছর হলে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।

কারণ : সেরিব্রাল পালসির সঠিক কারণ এখনও অজানা। তবে শিশু জন্মের আগে, জন্মের সময় এবং জন্মের প্রথম ৩ বছরের মধ্যে মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণই মূল হিসেবে ধরা হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের বিভিন্ন অসুস্থতা থাকলে, যেমন হাম, রুবেলা, ভাইরাল ফিবার, চিকেন পক্স, অনিয়ন্ত্রিত থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, সিফিলিস ইত্যাদি। এছাড়া গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় ফলিক এসিড গ্রহণ না করলে, খিঁচুনি হলে অথবা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও বাচ্চার সেরিব্রাল পালসি হতে পারে, যেমন গর্ভাবস্থায় অধিক ঘুমের ওষুধের ব্যবহার। প্রি-ম্যাচুর শিশু জন্ম নিলে। ডেলিভারির সময় ব্রেইনে আঘাত পেলে। জন্মের পর শিশু ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারলে। শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে, যেমন হঠাৎ জ্বর সঙ্গে খিঁচুনি, ডায়াবেটিস, মেনিনজাইটিস, ডায়ারিয়া, মাথায় টিউমার হলে, পোলিও হলে ইত্যাদি। বাবা-মায়ের ব্লাড গ্রুপ একই হলে। বংশগত কারণ ইত্যাদি।

লক্ষণ : শিশু জন্মের পর স্বাভাবিক নাও দেখা যেতে পারে। মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা ঝরতে থাকা। হাত-পা অতিরিক্ত শক্ত বা নরম থাকা। খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া। কথা বলায় সমস্যা বা স্পষ্ট না হওয়া। স্বাভাবিকভাবে বসতে, হামাগুড়ি দিতে, দাঁড়াতে কিংবা হাঁটতে সমস্যা। চলাফেরায় ভারসাম্যহীনতা। সাধারণ কাজ করতে অক্ষম। কিছু ক্ষেত্রে শিশু সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যাওয়া। কারও কারও হাতে-পায়ে অস্বাভাবিক নাড়াচাড়া থাকতে পারে (এথিটয়েড)। কারও কারও হাঁটার সময় এক পা আরেক পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা (সিজর গেট)।

অন্যান্য : শ্রবণপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিশক্তি কম, প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, মানসিক সমস্যা (অটিজম) সেরিব্রাল পালসির ধরন। ব্রেনের কোন অংশ কতটা আক্রান্ত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে সেরিব্রাল পালসিকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। ১. স্পাসটিক : প্রায় শতকরা ৯১ ভাগ সেরিব্রাল কর্টেক্স এ আঘাতের ফলে হয়ে থাকে। এ ধরনের সিপিতে মাসল এবং জয়েন্ট শক্ত ও দুর্বল হয়ে থাকে। ২. এথিটয়েড : মস্তিষ্কের ব্যাজাল-গ্যানগ্লিয়া এরিয়ায় আঘাতের ফলে এটি দেখা দেয়। মাংসপেশি খুব দ্রুত শক্ত হয়ে ওঠে, হাতে-পায়ে অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি দেয়। জিহ্বা এবং কণ্ঠনালি নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হওয়ায় এদের স্পিচ প্রবলেম হয়। ৩. অ্যাটাক্সিক : এটা খুবি বিরল, মূলত মস্তিষ্কের সেরিবেলামে আঘাত বা আক্রান্তের ফলে হয়ে থাকে। এতে শিশুর স্বাভাবিক চলাফেরা ও ফাইন মোটর স্কিলে সমস্যা হয়। ৪. মিক্স টাইপ : মিক্স টাইপে সবগুলোর সমন্বয়ের উপস্থিতি দেখা যায়, যেমন স্পাস্টিক ও অ্যাথিটয়েড।

ডায়াগনোসিস : ক্লিনিক্যাল অ্যাসিসমেন্ট ল্যাবরেটরি টেস্ট, ইসিজি সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ব্লাড টেস্ট, ক্রেনিয়াল আল্ট্রাসাউন্ড ইএমজি চিকিৎসা। সেরিব্রাল পালসির কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। তাছাড়া সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুর সমস্যা ভিন্ন ভিন্ন, তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসক, যেমন পেডিয়েট্রিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এবং চাইল্ড সাইকোলজিস্ট।

সেরিব্রাল পালসিতে ফিজিওথেরাপি : সেরিব্রাল পালসি চিকিৎসার ক্ষেত্রে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। কারণ প্রায় সবার কিংবা বেশিরভাগেরই কমন কিছু সমস্যা দেখতে পাওয়া যায়, যেমন মাসল দুর্বল এবং টাইট, জয়েন্ট স্টিফ, ব্যালেন্স, কো-অর্ডিনেশন এবং হাঁটাচলায় সমস্যা, হার্ট-লাংয়ের মাসল দুর্বল। এর কারণে ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট বা বুকে কফ জমা ইত্যাদি। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট শিশুকে সঠিকভাবে অ্যাসিসমেন্ট করে সমস্যা বুঝে তার জন্য প্রযোজ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচিং, স্ট্রেন্থেনিং ব্যালেন্স এবং গেইট ট্রেনিং ব্যবহার করে থাকেন শিশুকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে। স্ট্রেচিং : স্ট্রেচিং শিশুর হাত ও পায়ের মাসল-জয়েন্টকে নরম এবং স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে। মূলত এই স্ট্রেচিং এক্সারসাইজগুলো খুবই সেনসিটিভ প্রকৃতির হয়ে থাকে। স্ট্রেচিং কম দিলে কোনো কাজেই আসবে না, আবার বেশি দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে সেরিব্রাল পালসি শিশুর মাসল লেন্থ এবং জয়েন্ট রেঞ্জ ফিরিয়ে আনতে ‘স্ট্রেচিং’ অপরিহার্য। আর এজন্য অবশ্যই একজন ফিজিওথেরাপিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকেই স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ নিতে হবে। এছাড়া কিছু কিছু ডিভাইসের মাধ্যমে ও স্ট্রেচিং দেওয়া হয়। যেমন ফিজিও বল, স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, গেইটার, অ্যাডাকটর টুলস ইত্যাদি। শিশুর সমস্যা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এসব ডিভাইস ব্যবহার করা হয়।

স্ট্রেন্দেনিং এক্সারসাইজ : হাঁটা শুরু করার ক্ষেত্রে সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের সময় অনেকটা বেশি লাগে একটা সুস্থ শিশুর তুলনায়। কারণ যেখানে একটা সুস্থ শিশুর ‘বসা-হামাগুড়ি-হাঁটাহাঁটি-দৌড়ানো’ প্রক্রিয়াটি বেশ সময় সাপেক্ষ, সেখানে একটা সিপি শিশুর আরও বেশি সময় প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্ট্রেন্দেনিং এক্সারসাইজ, গেইট ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি প্যারালাল বার করা হয়।

ব্যালেন্স-কো-অর্ডিনেশন : কিছু কিছু সিপি শিশুর মাসল পাওয়ার এবং জয়েন্ট রেঞ্জ মোটামুটি হাঁটাচলার মতো ঠিক থাকে।

ডা. সুমনা পারভীন

ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ

ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল

মতিঝিল, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত