বেরিবেরি ও বঙ্গবন্ধু

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

প্রকাশ : ১০ জুন ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বেরিবেরি কী? আমাদের দেহে ভিটামিন বি-১ ঘাটতি দেখা দিলে যে রোগ দেখা দেয়, তাকেই মূলত বেরিবেরি রোগ বলে। একে অন্য কথায় থিয়ামিন ঘাটতি ও বলা হয়, যেহেতু ভিটামিন বি-১-এর অপর নাম থিয়ামিন। বেরিবেরির দুই ধরনের আক্রমণ দেখা যায়। একটা হলো ওয়েট বেরিবেরি এবং অন্যটা হলো ড্রাই বেরিবেরি। ওয়েট বেরিবেরিতে হার্ট এবং রক্ত সংবহনতন্ত্র আক্রান্ত হয়। চূড়ান্ত ক্ষেত্রে হার্ট ফেইলিওর হয়। ড্রাই বেরিবেরি স্নায়ু ধ্বংস করে দেয়, মাংশপেশির শক্তিও হ্রাস করে এবং ফলশ্রুতিতে মাংসপেশির প্যারালাইসিস উদ্ভূত হয়। বেরিবেরি রোগ উপযুক্তভাবে চিকিৎসা না করালে জীবন সংশয় হতে পারে। বেরিবেরির কারণ থিয়ামিন সমৃদ্ধ খাবার যিনি নিয়মিত খান, তার বেরিবেরিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। আজকের দিনে অধিকাংশ লোক অ্যালকোহল পানের সীমা ছাড়ানো অভ্যাসের কারণে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গর্ভকালীন অতিরিক্ত বমি হওয়া মা, এইডস আক্রান্ত মানুষ, ব্যারিয়াট্রিক সার্জারির রোগীও বেরিবেরিতে আক্রান্ত হয়। এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম যাদের আছে অর্থাৎ যাদের থাইরয়েড গ্রন্থি বেশি কাজ করে, সে রকম রোগীদেরও বেরিবেরি রোগ হয়। ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী, কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগীরাও বেরিবেরিতে আক্রান্ত হতে পারে।

ওয়েট বেরিবেরির লক্ষণ : শারীরিক ব্যায়ামকালে নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসা, নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসার জন্য ঘুম ভেঙে যাওয়া, হৃদস্পন্দনের হার দ্রুত হওয়া, পায়ের নিম্নাংশ ফুলে যাওয়া।

ড্রাই বেরিবেরির লক্ষণ : মাংসপেশির কাজ কমে যাওয়া, বিশেষত পায়ের নিম্নাংশে, হাতে-পায়ে ঝিনঝিন করা বা অনুভূতি হ্রাস পাওয়া, ব্যথা লাগা, মানসিক ঘোর লাগা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, বমি হওয়া, চোখের অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া, প্যারালাইসিস, চূড়ান্ত অবস্থায় মস্তিষ্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া বেরিবেরি রোগ নিরূপণ রক্ত ও প্রস্রাব হতে থিয়ামিনের মান নির্ণয়ের মাধ্যমে বেরিবেরি রোগ নিরূপণ করা যায়। থিয়ামিন শোষণে দেহের যদি কোনো অসুবিধা হয় তবে রক্তে থিয়ামিনের মাত্রার চেয়ে মূত্রে থিয়ামিনের মাত্রা বেশি হয়। এছাড়া বেরিবেরি আক্রান্ত ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্র পরীক্ষা করেও রোগ নিরূপণ করা যায়। হাঁটার সময় সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা দেয়, চোখের পাতা পড়ে যেতে পারে, মাংসপেশির প্রতিক্রয়া দুর্বল হয়ে যায়, স্মৃতি বিলোপ হয়। হার্টবিট দ্রুত হয়, পায়ের নিচের অংশে রসস্ফীতি হয়, শ্বাসকষ্ট হয়।

বেরিবেরির চিকিৎসা ভিটামিন বি-১ বা থিয়ামিন পরিপূরক ট্যাবলেট, শিরায় থিয়ামিন ইনজেকশন, থিয়ামিনসমৃদ্ধ বাদামি চালের ভাত আহার ইত্যাদির মাধ্যমে বেরিবেরি রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়।

বেরিবেরি প্রতিরোধভিটামিন বি-১-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ। যেমন : সীম, মটর, বরবটি, বীচিজাতীয় খাবার, মাংস, মাছ, শস্য, বাদাম, শতমূলী, পালংশাক, বিট, সিরিয়াল, বাদামি চালের ভাত ইত্যাদি। এছাড়াও অ্যালকোহল বর্জন করলে বেরিবেরিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।

বঙ্গবন্ধু ও বেরিবেরি : শেখ মুজিবের জন্ম হয় তার মায়ের গর্ভে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে। বাবা আর মায়ের আদর তার জন্য ছিল অবাধ ও উছলেপড়া। মায়ের হাতে আতপ চালের পায়েস তার ছিল প্রিয়। আর এ প্রিয়তাই তার জন্য হলো কাল। ১৪ বছর বয়সে, ১৯৩৪ সালে তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া, তখন তার পায়ের নিম্নাংশ ফুলে যেতে থাকে। হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। হৃৎপি-ের স্পন্দনগতি দ্রুত হয়ে ওঠে। তার রোগের উপসর্গ থেকেই বোঝা যায়, তিনি ওয়েট বেরিবেরি রোগে ভুগছিলেন। ওয়েট বেরিবেরি রোগ হৃৎপি- ও রক্ত সংবহনতন্ত্রকে আক্রমণ করে। অধিক হারে আতপ চালের পায়েস খাওয়ার কারণে তার দেহে ভিটামিন বি-১ বা থিয়ামিনের ঘাটতি হয়, যা মূলত বাঙালিরা তখনকার দিনে ঢেঁকিছাঁটা চাল থেকেই বেশি পেত। চিকিৎসার জন্য তাকে কলকাতা নেওয়া হলে কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক শিবপদ ভট্টাচার্য ও একে রায় চৌধুরী তার চিকিৎসা করেন। তারা তার রোগকে বেরিবেরি বলে নিরূপণ করেন ও আতপ চালের পায়েসে নিষেধাজ্ঞা এনে খোসাযুক্ত ঢেঁকিছাঁটা চালের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন। ধীরে ধীরে রোগ ভালো হয়ে এলেও হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা না কাটায় তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান তাকে খুব বেশি ফুটবল খেলতে দিতেন না।

ডা. পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

এমবিবিএস (সিএমসি)

মেডিসিন ও হৃদরোগের চিকিৎসক

লেকচারার চাঁদপুর ম্যাটস ও সভাপতি

বিপিএমপিএ, চাঁদপুর