হাতের কবজির ব্যথা কারণ ও চিকিৎসা
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কবজির ব্যথা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। হঠাৎ ইনজুরির কারণে কবজিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে। মচকে গেলে কিংবা হাড় ভেঙে কবজিতে বেশ ব্যথা হয়। তবে অনেক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্য কবজিতে ব্যথা হতে পারে, যেমন- বারবার কবজিতে চাপ, বাত ও কারপাল টানেল সিনড্রোম। যেহেতু অনেক কারণে কবজিতে ব্যথা হতে পারে, তাই কখনও কখনও দীর্ঘমেয়াদি কবজির ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সঠিক রোগ নির্ণয় করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তার ওপর নির্ভর করে আপনার কবজির ব্যথার সঠিক চিকিৎসা।
কবজির ব্যথার উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হয়। এটি নির্ভর করে ঠিক কী কারণে ব্যথা হচ্ছে তার ওপর। যেমন- অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ঠিক ভোঁতা ধরনের দাঁত ব্যথার মতো, অথচ টেনডনের প্রদাহ বা টেনডিনাইটিসের ব্যথা সাধারণত তীক্ষè ও ধারালো ধরনের।
কবজির ব্যথার কারণ
কবজি বা রিস্টজয়েন্ট হলো একটি জটিল সন্ধি যা তৈরি হয়েছে কয়েকটি হাড়ের সমন্বয়ে। যেমন- রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আটটি ছোট ছোট কারপাল হাড়। এই কারপাল হাড়গুলো দুই সারিতে সাজানো। লিগামেন্টের শক্ত ব্যান্ড কবজির হাড়গুলোকে একে অন্যের সঙ্গে, রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং হাতের হাড়গুলোকে সংযুক্ত করে। টেনডনগুলো হাড়ের সঙ্গে মাংসপেশিকে সংযুক্ত করে। কবজির যেকোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথা হতে পারে এবং হাত ও কবজির ব্যবহারের সক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কবজি ব্যথার সাধারণ কারণগুলো এখানে বর্ণিত হলো :
১. ইনজুরি
হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলে কবজিতে খুব বেশি ইনজুরির ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে কবজি মচকে যায়, কবজিতে টান পড়ে এবং কবজির হাড় ভেঙেও যায়। কবজির বুড়ো আঙুলের দিকে হাড়টির নাম স্কাফয়েড। এটি অনেক সময় ভেঙে যায়। এ ধরনের হাড় ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা এক্স-রেতে নাও দেখা যেতে পারে। ব্যথা অনেক দিন থাকে, কবজি নাড়াচাড়া করলে ব্যথা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে হাত দিয়ে কাজ করা যায় না। প্লাস্টার করেও ব্যথার উপশম হয় না। অপারেশন করতে হয়। অনেক সময় স্কাফয়েড হাড় ভাঙলে হাড়ের মধ্যে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় এবং হাড়ের জোড়া লাগতে সমস্যা হয়, যার ফলে ব্যথা হয় ও কবজি নাড়তে অসুবিধা হয়। তখন অপারেশনের প্রয়োজন হয়। হাতের ওপর ভর দিয়ে পড়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলিস ফ্রাকচার হয়। এ ক্ষেত্রে রেডিয়াসের নিচের অংশ ভেঙে যায়। কবজি ফুলে যায়।
কবজি বারবার নাড়াতে হয় এমন যেকোনো কাজ যেমন- টেনিস বল খেলা থেকে শুরু করে বেহালা বহন করতে করতে কবজির সন্ধির চার পাশের টিস্যুতে প্রদাহ হতে পারে কিংবা হাড় ভেঙে যেতে পারে। বিশেষ করে কোনো বিরতি ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবজির কাজ করলে। বারবার চাপের ফলে হাতের কবজির ব্যথার আরেকটি কারণ হলো ডি কোয়ার ভেইনস ডিজিজ। ব্যথা বুড়ো আঙুলের মূলে অনুভূত হয়। ডি কোয়ার ভেইনস ডিজিজে কবজি নাড়তে খুব ব্যথা হয়, কাজ করতে অসুবিধা হয় এবং অনেক সময় কাজের পর ব্যথা বেশ বেড়ে যায়। বুড়ো আঙুলে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
২. আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা
অস্টিও আর্থ্রাইটিস : সাধারণত কবজিতে অস্টিও আর্থ্রাইটিস খুব কম হয়। কোনো লোকের কবজিতে আগে ইনজুরি হয়ে থাকলে পরে অস্টিও আর্থ্রাইটিস হয়। এ ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ছিঁড়ে যায় বা ক্ষয় হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস : এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার নিজস্ব টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। কবজিতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। যদি একটি কবজি আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণত অন্য কবজিতেও এটি ঘটে।
৩. অন্যান্য রোগ ও অবস্থা
কারপাল টানেল সিনড্রোম : আপনার কবজির তালুর দিকের অংশে একটি পথ রয়েছে যার নাম কারপাল টানেল; এর মধ্য দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ অতিক্রম করে। মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়লে কবজি ও হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ অবস্থার নাম কারপাল টানেল সিনড্রোম।
গ্যাংলিয়ন সিস্ট : কবজির ব্যথার অন্যতম কারণ হলো এক ধরনের টিউমার জাতীয় ফোলা বস্তু থাকে যাকে গ্যাংলিয়ন বলে। এটি ওঠে টেনডনের আবরণী থেকে কবজির পেছনে অথবা সামনের দিকে। কবজি নাড়লে ব্যথা হয়। বড় গ্যাংলিয়ন সিস্টের চেয়ে ছোটগুলো বেশি ব্যথা সৃষ্টি করে।
কিয়েন বক্স ডিজিজ : এটি সাধারণত তরুণদের হয়। এ ক্ষেত্রে কবজির লুনেট নামের ছোট হাড়টিতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে হাড়টি কোলাপস করে। লুনেট হাড়ের ওপরে চাপ দিলে ব্যথা লাগে এবং রোগী হাত মুঠো করে ধরতে পারে না।
কবজি ব্যথার ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো হলো
কারো হাতের কবজিতে ব্যথা হতে পারে- তা অল্প কাজ করুক কিংবা বেশি কাজ করুক না কেন। কিন্তু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের কারণে এ ব্যথা বেড়ে যেতে পারে, যেমন-
খেলাধুলা করা : বিভিন্ন খেলাধুলায় কবজিতে ইনজুরি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বোলিং, গলফ, জিমন্যাস্টিক, টেনিস প্রভৃতি।
বারবার কাজ করা : বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাত ও কবজির যেকোনো কাজ বারবার করলে কব্জির ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
চিকিৎসা : হাতের কবজির ব্যথার চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ইনজুরির গ্রণ, স্থান ও তীব্রতা সর্বোপরি বয়স ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। প্রথমত, আক্রান্ত হাতের কব্জিকে বিশ্রামে রাখতে হবে এবং যদি কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে কবজিতে ব্যথা হয়ে থাকে তাহলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ যেমন- আইবুপ্রফেন ও অ্যাসিটামিনোফেন কবজির ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। প্রয়োজনে শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।
ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল
সহযোগী অধ্যাপক
অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
