ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীকে সাহস জুগিয়েছে মোনেম পরিবার

আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল) তৈরি হয়েছে কনস্ট্রাকশনের মধ্য দিয়েই। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অবকাঠামো উন্নয়নে এএমএলের ছোঁয়া বা স্পর্শ রয়েছে। দেশের সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, দুই বিমানবন্দরের রানওয়ে, মেট্রোরেল প্রকল্প এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত থাকাটা আবদুল মোনেম লিমিটেডের বড় পাওয়া- বলছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম। প্রমত্তা পদ্মায় সেতু নির্মাণের পেছনের অনেক অজানা কথা আজ শুনব তার কাছ থেকে। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার ও বিজনেস ইনচার্জ জোনায়েদ মানসুরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীকে সাহস জুগিয়েছে মোনেম পরিবার

আবদুল মোনেম লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর গল্পটা অনেকেরই জানা। তবে অনেকেরই অনেক কিছু অজানাও রয়েছে। পদ্মায় সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক কী কারণে মুখ ফিরিয়ে নিল। কেন অর্থায়ন করেনি। সেসব বিষয়ে তিনি যাবেন না। বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন না করার কারণে অনেক দেশ ও অনেক উন্নয়ন সংস্থা পিছিয়ে গেছে। তখন পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেমে গেছে। ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এএমএল কন্সট্রাকশনসের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে আপগ্রেডেশন প্রকল্প কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যান (ইন অপারেট করতে যান)। ওই অনুষ্ঠানে এএমএলের চেয়ারম্যান আবদুল মোনেম ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পদ্মা সেতুর প্রজেক্টে তিনটি বিষয়ে হাইলাইট করার সুযোগ পান। বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব সহকারে শোনেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল, সাহস ছিল, আত্মশক্তি ছিল। নিজস্ব মনোবল ও বুদ্ধিদীপ্ততার কারণে আজ পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ২০১০ সালের ১১ মে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। চূড়ান্ত মূল্যায়ন শেষে ২০১১ সালের মাঝামাঝি ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। বিশ্বব্যাংকের আপত্তিতে ২০১১ সালের আগস্টে প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। নানা জটিলতা শেষে প্রায় ২ বছর পর ২০১৩ সালের ২৬ জুন ফের চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেনই- এই শক্তি ও সৎসাহস ছিল। প্রাধানমন্ত্রীর এই সৎসাহসের জায়গায় অর্থনৈতিক দিক থেকে কয়েকটি পয়েন্ট যুক্ত করতে সুযোগ পেলেন আবদুল মোনেম ও এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম। তারা বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংক যদি পদ্মা সেতুতে টাকা নাও দেয়, তবুও পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা সম্ভব।’ তখন বলা হলো- যমুনা সেতুতে বছরে ৫০০ কোটি টাকা টোল আদায় হলে, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে হাজার থেকে ১২শ’ কোটি টাকা টোল আদায় করা সম্ভব। তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮-২০ হাজার কোটি টাকা। যমুনা সেতুর চেয়ে পদ্মা সেতু বড় হবে, তাই এতে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর বিনিয়োগের টাকা উঠে আসবে (প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি অর্থনৈতিক বিষয়ে কথা হয়)। সেতুর স্থায়িত্ব হতে পারে ৮০ থেকে ১০০ বছর। প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা গুরুত্বসহকারে আমলে নেন। ওই আলোচনায় উঠে আসে পদ্মার দরপত্র স্থগিত হয়ে যাওয়ার কারণ। পদ্মার ভবিষ্যৎ নিয়ে কারও জানা নেই। তখন এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম অনুরোধ করলেন, পদ্মার মূল সেতুর কাজ না হলেও অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ দেরিতে হলেও, সময় পাবে সেতু কর্তৃপক্ষ। অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ শেষ করতে পারলে সময় বাঁচবে। দুই পারের মানুষের যাতায়াত, মালামাল আনা-নেওয়ায় সময় কমবে। ফেরির ডিসটেন্স কয়েক ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে কিছু কাজ এগিয়ে যাবে। এ কথাগুলো শুনে প্রধানমন্ত্রী হয়তো কারও কারও সঙ্গে কয়েক দিন আলোচনা করেন। এদিকে এএমএল টেন্ডারে লোয়েস্ট হয়ে বসে আছে (সর্বনিম্ন দরদাতা) কাজ করার জন্য। এএমএলের খরচ বাড়ছে।

আবদুল মোনেম লিমিটেডের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলতে থাকে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে মেগা অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এই কার্যক্রম গতি পায়। অবশেষে ওই মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৩ সালে অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার হয়। তখনই টেন্ডার প্রসেস চালু হয়। এই থেকেই পদ্মা সেতুর মূল কাজের যাত্রা শুরু হয়। এই হলো ইতিহাস। এটা অনেকেরই অজানা। আবদুল মোনেম লিমিটেডের অ্যাপ্রোচ সড়কের মধ্য দিয়েই পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাথমিক কাজের ধাপ শুরু হয়।

এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, এইসিওএমের নকশায় পদ্মা নদীর ওপর বহুমুখী আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট। সে সময় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়ায় সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র আহ্বান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণকাজ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল। আবদুল মোনেম লিমিটেড পদ্মা সেতুর কাজের সঙ্গে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল। এদিকে ২০১১ সালে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ও প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহার সেতুটির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছিল। ২০১২ সালে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার ধারাবাহিকতাতেই সেতুর মূল পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ শুরু হয়। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। মূল সেতুর জন্য চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে নিযুক্ত করা হয়। চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদীশাসনের কাজ করে। বেশ কয়েকটি স্থানীয় কোম্পানি এ কাজে নিযুক্ত থাকলেও এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল)। আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের চুক্তি দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে) দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তখনকার প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব শফিকুল ইসলাম ও চায়না মেজর ব্রিজের পক্ষে লিউ জি নি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। ২০১৭ সালের অক্টোবরে মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প শুধু দেশীয় বা নিজস্ব অর্থায়নের বিবেচনাতেই নয়, বৈশ্বিক বিবেচনায়ও একটি বড় প্রকল্প। এ ধরনের একটি প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, ঠিকাদারদের কাজ পর্যালোচনা ও তদারকি এবং সামগ্রিকভাবে এর ব্যবস্থাপনার কাজটি খুবই জটিল ও কঠিন ছিল। সতর্কতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। সেই সংশ্লিষ্টদের কাতারের প্রথম সারিতে রয়েছে আবদুল মোনেম শিল্প পরিবার। পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১৬ কোটি বাংলাদেশির স্বপ্নপূরণের যাত্রা শুরু হয়। এ স্বপ্নপূরণের যাত্রায় আবদুল মোনেম লিমিটেড ছিল সবার অগ্রভাগে।

আবদুল মোনেমের কনিষ্ঠ পুত্র এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাথমিক যাত্রা ছিল অনেক কঠিন। অনেক চ্যালেঞ্জের। অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম তিনটি ক. বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে তৈরির চ্যালেঞ্জ। খ. রাজনৈতিক অস্থিরতা। গ. প্রমত্তা পদ্মায় কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। প্রমত্তা পদ্মায় কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা মধ্যে অন্যতম ছিল- মূল সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ, নদীশাসন, জাজিরা সংযোগকারী সড়ক, দুই পারের মাটির দুর্বলতা। দু’পারের মাটিকে কোয়ালিটি পর্যায়ে আনতে ১ বছরের বেশি সময় লেগেছে। মাওয়া-জাজিরা সড়ক আন্তর্জাতিক মানের। আমেরিকাণ্ডইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে অনেক ভালো। এসব কাজ করতে আবদুল মোনেম লিমিটেডের অনেক খরচও হয়েছে। অনেক ক্ষতিও হয়েছে। নদীশাসনের মধ্যে পদ্মা নদীর তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে অনেক ঝামেলা ও বেগ পেতে হয়েছে তাছাড়া তলদেশের মাটি ছিল তুলনামূল খুব নরম, পাইলিংয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক স্রোত বা প্রবাহও ছিল। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পর সমস্যা দেখা দেয়। জার্মানি থেকে অনেক যন্ত্রাংশ আনতে হয়েছে। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করেন। স্ক্রিন গ্রাউটিং নামের এই পদ্ধতিতেই বসানো হয় পদ্মা সেতু। এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়। তারপর ওই মাটিতে পিলার গেঁথে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়। পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। কেমিক্যালের প্রভাবে তখন তলদেশের সেই নরম মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। একপর্যায়ে সেই মাটি পাইলের লোড বহনে সক্ষম হয়ে ওঠে। তখন আর পাইল বসাতে কোনো বাধা থাকে না।

এসব অনুভূতির আগে তিনি বলেন মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতের কথা। অশেষ মেহেরবানিতে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামোর একটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৎইচ্ছা ছিল, মনোবল ছিল প্রখর। তিনি পদ্মা সেতু নিজ অর্থায়নে করবেনই। সে জায়গায় তাদের এক্সপোজার, আত্মবিশ্বাস এবং নৈতিক সাহসের কিছু আলোচনা, পরামর্শ যুক্ত করতে পেরেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে শুরু থেকে থাকতে পেরেছেন- এটাই তাদের বড়ো প্রাপ্তি; পরম পাওয়া। তবে এ প্রাপ্তিতে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। আর চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছেন বলেই এ বড় প্রকল্প গ্রহণে অংশীদার হতে পেরেছে এএমএল। তবে প্রথম দিকে এএমএলের পক্ষে ফিন্যান্সারদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে রাজি করা সহজ ছিল না। পারফরম্যান্স গ্যারান্টি, অ্যাডভান্স পেমেন্ট, অন্যান্য নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে আবদুল মোনেম লিমিটেডেকে। অনেক বেগ পেতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার বাবা আবদুল মোনেমের সততা, বিচক্ষণতা, আত্মবিশ্বাস, প্রতিষ্ঠানের গুডইউলের কারণে তারা আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপায় সব সমস্যা সমাধান করতে পেরেছেন। আবদুল মোনেম নিজেই কাজ দেখতে সশরীরে যেতেন। অ্যাপ্রোচ সড়কে সরকার যে টাকার টেন্ডার দেয়, তার চেয়ে ১০০ কোটি টাকা কম খরচে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অ্যাপ্রোচ সড়ক সরকারকে তুলে দিতে পেরেছে এএমএল কনস্ট্রাকশন। টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে বসে থেকে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। অনেক ক্ষতি হয়েছে তাদের। শুরুতে কাজ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানের কাজে ক্ষতি হলে তার ক্লেইম করা যায় ক্ষতিপূরণের জন্য। তারা বড় অঙ্কের ক্ষতির ক্লেইমও করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার বাবা আবদুল মোনেমে বিষয়টি জানতে পেরে দেশের স্বার্থে, দেশের জনগণের স্বার্থে নিজেদের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে জেনেও সে ক্লেইম সাবমিট না করে অভিযোগ তুলে নেন। কারণ বাবার কমিটমেন্ট ছিল, দেশের প্রতি দরদ ছিল, ভালোবাসা ছিল, দেশের জনগণ এ পথ দিয়ে চলবে, মালামাল আসা-যাওয়া হবে, কর্মসংস্থান হবে। এতে যে দোয়া পাবেন- এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট পাওয়া, বললেন তারা বাবা। সে বাবার আদর্শে তারা সজাগ আছেন। তার আদর্শ সবসময় ধারণ করে চলেছেন। সামনের দিনগুলো দেশের ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই কাজ করবেন তিনি। আর দায়িত্বশীল নাগরিক কি জিনিস তা তার বাবার কাছ থেকেই শিখেছেন। বাবার আদর্শে চলেছে আবদুল মোনেম শিল্প পরিবার।

আর অনুভূতির কথা বললে তিনি বলেন, এটা নিঃসন্দেহে সদগায়ে জারিয়া। লাখ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হবে এখান থেকে। চলাফেরা হবে। পণ্য আনা-নেওয়া হবে। শিশু থেকে বৃদ্ধ- অনেক রোগী, অনেক আলেমণ্ডওলামা আসা-যাওয়া করবেন। ওইসব মানুষদের মন থেকে দোয়া আসবে। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে অংশীদার হতে পেরেছেন- এর চেয়ে আর কী অনুভূতি হতে পারে। তবে একটু কষ্ট আছে মনে; যে বাবা নিজে গিয়ে সশরীরে পদ্মার কাজ (ফিজিক্যাল সুপারভিশন করতেন) দেখেছেন, সে বাবা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখতে পারলেন না।

আর অর্থনৈতিক দিকে থেকে অনুভূতি হলো- পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ২ শতাংশ জিডিপি যোগ হবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের অর্থনীতি এবং সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধির ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকার ওপর চাপ কমবে। জানজটের দীর্ঘ লাইন থাকবে না। সময় বাঁচবে। ডিসেন্টালাইজেশন হবে। অনেক উন্নয়ন হবে। অনেক কর্মসংস্থান হবে। এশিয়া ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ, পণ্য পরিবহন, বন্দর সুবিধার পুরোপুরি সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে- বলেন তিনি।

এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম আরও জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে- সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। জানা গেছে, ১৯৫৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণ শিল্পের সামনের কাতারে এএমএল কন্সট্রাকশনস লিমিটেড দেশের অন্যতম শীর্ষ কন্সট্রাকশনস ফার্ম। গত ৫৫ বছরে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো বড় সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে আবদুল মোনেম শিল্প পরিবারের ১২ থেকে ১৫ শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১২ হাজারের অধিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত