ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা

ড. সায়মা হক বিদিশা
উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা উপায়ে নারীরা অবদান রেখেছে, বিশেষ করে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে নারী পোশাক শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য, তবে পোশাক শিল্প ছাড়াও কৃষি কিংবা সেবা খাত, বিশেষ করে খামারবহির্ভূত কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে নারী শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যদিও সে অবদানের বিষয় খুব একটা আলোচিত হতে আমরা দেখি না। তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা, অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রে নারীর অবদান, যা কিনা অর্থনীতি কিংবা সামাজিক মানদণ্ডের বিচারেও অস্বীকৃত ও অপ্রদর্শিত। সাম্প্রতিক সময়ে গৃহস্থালি ও সেবাকাজে নারীর অবদানের বিষয়টিকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আলোচনায় এলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ-জাতীয় কাজকে গুরুত্বহীন ও অর্থনৈতিকভাবে অর্থবহ হিসেবে কখনোই বিবেচনা করা হয়নি। যদিও গত ৫০ বছরে এর মূল্যমান হিসাব করলে বোঝা সম্ভব যে, অর্থনীতিতে এ ধরনের কাজের গুরুত্ব কতটা ব্যাপক। তাই গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় শ্রমবাজারের সাপেক্ষে নারীর অবদান বিশ্লেষণ করতে চাইলে স্বীকৃত ও অস্বীকৃত উভয় প্রকার অবদানকেই বিবেচনায় আনা জরুরি।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে এ বিষয়ে দ্বিমত করার অবকাশ নেই যে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনসহ মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এ উন্নয়নের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন কিংবা বিশ্লেষণ খুব একটা সুনির্দিষ্ট কিংবা সুস্পষ্ট নয়, তার পরও এ উন্নয়নে নারীর অবদানকে বিশেষভাবে আলোচনায় আনার প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে নারী তার শ্রমের মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ ধরনের লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ করতে গেলে শ্রমবাজারে নারীর অবস্থানের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ জরুরি। মূল ধারার শ্রমবাজারে গত কয়েক দশকে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সত্তরের দশকের জন্য তুলনামূলক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও ১৯৭৪ সালের শুমারি থেকে বলা চলে যে, সত্তরের দশকের মধ্যভাগে ১০ বছরের ওপরের ব্যক্তির শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ছিল ২৮.৭ শতাংশ, যেখানে নারীর (১০ বছরের ওপরের বয়সের) জন্য এ হার ছিল মাত্র ২.৬ শতাংশ, এমনকি আশির দশকেও শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের এ হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পাই এবং এ দশকের শুরুর দিকে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৫১ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকের শেষে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার দাঁড়ায় ২৩ শতাংশ ও ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এ হার ছিল ৩৬ শতাংশ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হারের এ ইতিবাচক গতিপ্রকৃতির পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে আশি ও নব্বইয়ের দশকে তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ও এ খাতে নারী শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য হারে অংশগ্রহণ। এ খাতের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ শ্রমিকই ছিল নারী শ্রমিক। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক বা চলক হিসেবে স্বীকৃত তৈরি পোশাক খাতের বিকাশে নারীর অবদান তাই অনস্বীকার্য। তবে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কৃষিতেও গত কয়েক দশকে নারীর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, যা আমরা অনেক সময় সেভাবে আলোচনায় দেখতে পাই না।

তবে সার্বিকভাবে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশেই নিম্নমজুরির, নিম্ন উৎপাদক ও মূলত অনানুষ্ঠানিক কাজে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে নারীর কর্মসংস্থানের কিছুটা গুণগত পরিবর্তন হলেও এখনও ৯১.৮ শতাংশ নারীই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ৮২.১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এ ধরনের কাজের মাধ্যমে সাময়িক জীবিকা নির্বাহ করা গেলেও তা শ্রমিককে অর্থনৈতিক সুরক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে সেভাবে সক্ষম হয় না। তাই অর্থনীতির অগ্রগতিতে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক কাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও নারীর নিজস্ব অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এ ধরনের কর্মসংস্থানের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে কিছুটা সীমিত। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চমজুরির কাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণই কম এবং এ হার নারীর ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই আরও কম। ২০১৬-১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী পরিচালক পদের মাত্র ১০.৭ শতাংশে নারী কর্মরত ছিলেন আর পেশাজীবী পদে এ হার ৩২.৫। এ পরিপ্রেক্ষিতে, নীতিপ্রণেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদের ১০.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে নারী অধিষ্ঠিত রয়েছে। আশার বিষয়, এই যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় কম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এসব কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে সার্বিকভাবে শ্রমবাজারে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অবশ্য ২০১০ সালের পর তেমন বাড়েনি। ২০১৩ সালে কিছুটা কমে ২০১৬-১৭-এর শ্রম জরিপ অনুযায়ী এ হার পৌঁছেছে ৩৬.৩ শতাংশে (২০ মিলিয়ন), যার মধ্যে ১.৩ মিলিয়ন নারী আবার বেকার। অর্থাৎ শ্রমশক্তিতে তারা থাকলেও তাদের শ্রমকে অর্থনীতিতে সরাসরি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না (শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৬-১৭)।

তবে দেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণে সংখ্যাগত আলোচনার বাইরে গিয়ে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, মূলধারার মজুরিযুক্ত শ্রমের মাধ্যমেই শুধু নয়, পারিবারিক শ্রম যার জন্য নারী কোনো মজুরি পায় না, তার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি (মূলত কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প) সবসময়ই সমৃদ্ধ হয়ে আসছে। এখানে উল্লেখ্য, পারিবারিক শ্রমিক হচ্ছে তারা, যারা তাদের স্বামী অথবা শ্বশুরের (কিংবা বাবা বা ভাইয়ের) জমি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত আছে। সুতরাং তাদের শ্রমের বিনিময়ে তারা কোনো পারিশ্রমিক না পেলেও তাদের উৎপাদিত সামগ্রী (মূলত বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য) জাতীয় আয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সত্তর কিংবা আশির দশকের জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও বলা চলে, নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলকভাবে মজুরিযুক্ত কাজে নিয়োজিত নারীদের হার বেড়েছে এবং পারিবারিক শ্রমিক নারীর হার কমেছে। তবে মনে রাখা জরুরি, মজুরি না পেলেও পারিবারিক শ্রম অর্থনীতির সংজ্ঞায় মজুরিযুক্ত অন্যান্য কর্মসংস্থানের মতোই শ্রমবাজারে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃত এবং জাতীয় আয়ে এ শ্রম ও শ্রম কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদানের বিষয়ে আমাদের কিন্তু শুধু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেই চলবে না। কারণ নারীর শ্রমের একটি বিশাল অংশই শ্রমবাজারের পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে যায়। নারী তার দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করে, যার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয় না। রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড় কাচা, শিশু ও বয়স্কদের যত্ন, সন্তানের পড়ালেখায় সাহায্য, রান্নার জন্য জ্বালানি কিংবা পানি আনা ইত্যাদি কাজ শ্রমবাজারের গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেও পরিগণিত হয় না এবং জাতীয় আয়ের হিসাবেও আসে না। তাই এ ধরনের কাজের মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীর অবদান অদৃশ্যই থেকে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর, সময় ব্যয় জরিপ ২০১২ অনুযায়ী একজন নারী যে কর্মজীবী নয় (অর্থাৎ মূলধারার শ্রমবাজারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়) সে গৃহস্থালি কাজে প্রতিদিন গড়ে ৬.২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। অন্যদিকে একজন কর্মজীবী নারীর জন্য এ সংখ্যা গড়ে ৩.৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারীরা তাদের এ শ্রমঘণ্টায় যেসব কাজ করে, সেসব কাজের মূল্যমান হিসাব করা হয় না এবং এসব কাজ, যা কি-না প্রাথমিকভাবে নারীই করে, তার অবদানও অস্বীকৃত থেকে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম সময় ব্যয় জরিপ ২০১২ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ ব্যবহার করে দেখিয়েছে, নারীর এ অপ্রদর্শিত গৃহস্থালি কাজের বার্ষিক আর্থিক মূল্য ২০১৬-১৭-এর জাতীয় আয়ের ৩৯.৫২ শতাংশের সমপরিমাণ (সানেম- মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ২০২০)। প্রতিস্থাপন পদ্ধতি ও সুযোগ ব্যয় পদ্ধতির মাধ্যমে এ মূল্যমান হিসাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের কাজের জন্য যদিও নারী স্বীকৃতি পায় না (মজুরিও পায় না), এ কাজের জন্য যদি মজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হতো, তবে তাদের মজুরি দেওয়া হতো এবং অর্থনীতিতে এ অবদান স্বীকৃতি পেত। অন্যদিকে ওই নারী যদি এ সময় মজুরিভিত্তিক কাজে নিয়োজিত হতো তবে কাজের জন্য মজুরিও পেত। এ গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যেসব নারী মূলধারার শ্রমবাজারে নিয়োজিত নয় তাদের ক্ষেত্রে এ অপ্রদর্শিত শ্রম ২০১৬-১৭-এর জাতীয় আয়ের ৩১.৪১ শতাংশ, মূলধারার কাজে নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ৬.৮৫ শতাংশ। এছাড়া ভিন্ন গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এসব গৃহস্থালি কাজ ও প্রজনন-সংক্রান্ত দায়িত্বের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারী আনুষ্ঠানিক বাজারকেন্দ্রিক কার্যক্রমের বাইরে থাকতে বাধ্য হয়, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, যেখানে বাজারকেন্দ্রিক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বেশি অবদান হয়তো রাখতে পারত। সাম্প্রতিক সময়ে স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টিংয়ের মাধ্যমে এ ধরনের কাজের মূল্যমান নির্ধারণ ও জাতীয় আয়ে এ মূল্যমানের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। নারীর এ অস্বীকৃত কাজের স্বীকৃতি যেমন পরিবারে ও সমাজে নারীর মর্যাদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে মনে করা যেতে পারে, তেমনি স্বীকৃতির পাশাপাশি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও নারীবান্ধব কর্মস্থলও নারীর গৃহস্থালি কাজের ভার লাঘবের মাধ্যমে মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখা যায়, কৃষি খাত যেটি সত্তর ও আশির দশকে জাতীয় আয়ের মূল উৎস ছিল (১৯৮৪-৮৫ সালের জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধেকই ছিল কৃষি খাতের অবদান), সে খাতে নারীর অংশগ্রহণও ছিল বেশি। যদিও সত্তর ও আশির দশকের ক্ষেত্রে তুলনামূলক উপাত্তের অভাব রয়েছে, তার পরও শুমারির তথ্যের ভিত্তিতে বলা চলে, নারীদের মূলধারার কর্মসংস্থানের মূল উৎস ছিল কৃষি। অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে পরে নব্বইয়ের দশক ও তার পরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে কমেছে। কৃষি খাতে নারীর এ অবদানের কারণে বলা ভুল হবে না যে, সার্বিকভাবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে নারীর শ্রমের অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তবে এটি সত্যি যে, অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের সুফল কিন্তু সেভাবে নারীরা পায়নি। তুলনামূলক বিচারে কৃষিকাজ সাধারণত নিম্ন-উৎপাদক ও নিম্নমজুরির। তুলনামূলকভাবে উচ্চ-উৎপাদক সেবাসংক্রান্ত কাজে ও শিল্প খাতে রয়েছে কাজে নিয়োজিত নারীর মাত্র ২৩.৫ ও ১৬.৮ শতাংশ (পুরুষের হার ৪৫.৮ ও ২২.০ শতাংশ। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি খাতে অবদানের মাধ্যমে নারী নিজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও উচ্চ-উৎপাদনশীল অকৃষি খাতের মাধ্যমে নারীর নিজস্ব ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী অনেকটাই পিছিয়ে আছে।

কৃষির পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর মূলধারার কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি পোশাক খাত, যার বিকাশে নারী শ্রমিকের বিশেষ অবদান রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নব্বইয়ের দশকে মূলত নারী শ্রমিকনির্ভর হলেও বর্তমানে এ খাতের ৬০-৬৫ শতাংশ মাত্র নারী শ্রমিক। তুলনামূলকভাবে নারী শ্রমিকের হার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমলেও ২৭.৯৫ বিলিয়ন ডলারের (২০২০) রপ্তানির খাতটি মূলত স্বল্পমজুরির নারী শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল। তবে রপ্তানি আয় আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই শুধু নয়, বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে যে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, তৈরি পোশাক শ্রমিকের খানার শিশুদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়সহ নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে এ খাতে নিয়োজিত নারী।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নারীর কর্মসংস্থানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭.২ শতাংশ নারীর মালিকানাধীন, যার বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। আমাদের জাতীয় আয়ে এ খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। তাই এ খাতের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা নিজ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদেরও জীবিকার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং জাতীয় আয়ে অবদান রাখছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির পাশাপাশি অন্তত দুই দশক ধরে প্রবাসী নারী শ্রমিকরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমেও দেশীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত অভিবাসী নারী শ্রমিক ১ শতাংশের নিচে থাকলেও গত কয়েক বছরে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে মনে রাখা জরুরি যে, শুধু শ্রমবাজার ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণই নয়, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে উচ্চ-উৎপাদক কাজে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে নারীর শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আরও বাড়ানো সম্ভব। সে পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে কম বয়সে বিয়ে ও সন্তানধারণের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও প্রয়োজন সমন্বিত ও সুসংগঠিত উদ্যোগ। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের মতো পদক্ষেপের সঠিক বাস্তবায়ন, কর্মজীবী নারীদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসন ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা নারীকে মূলধারার শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করার চেষ্টা করা জরুরি। পরিশেষে বলা চলে যে, অর্থনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতিনির্ধারণ ও প্রয়োগ এবং পাশাপাশি দরকার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত