বিশ্বায়ন মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপ এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য প্রাণীকুলকেও স্পর্শ করে। বিশ্বের সমস্ত জাতি ইতিবাচক বা নেতিবাচক পদ্ধতিতে এর প্রভাবে পরিচালিত হয়। এটি বর্তমানে একটি পরিপক্ব এবং প্রাকৃতিক ঘটনা যা আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর দিকগুলোকে প্রভাবিত করে। উদারতাবাদ, নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং মুক্তবাজারমুখী প্রবণতা বিশ্বায়নের মূল প্রতিপাদ্য ও আদর্শ। এটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিমাণ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে; কিন্তু দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারত্ব, ন্যায্যতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেশিরভাগই এক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতিতে রয়েছে।
১৯৪৭ সালে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, দ্য জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড ((GATT) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মাতৃ সংস্থা। এর মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের বৈষম্য দূর করা এবং ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করা। ম্যাকলুহান (১৯৫৪) মিডিয়া সম্পর্কে তার বিখ্যাত গবেষণায় ‘দ্য গ্লোবাল ভিলেজ’ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। বছরের পর বছর ধরে বিশ্বায়নের ধারণাটি বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিত ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে এবং অনেকেই একে নেতিবাচক দিক থেকে উপস্থাপন করেছেন। বিশ্বায়ন এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একক বিশ্ব সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। বিশ্বায়ন ধারণাটি পুরোনো হলেও সমাজবিজ্ঞানী রোল্যান্ড রবার্টসন ১৯৯২ সালে তার এক প্রবন্ধে সর্বপ্রথম ‘বিশ্বায়নকে’ সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিই বিশ্বায়নকে বিশদভাবে উপস্থাপন ও বর্ণনা করেছেন।
সাধারণ অর্থে, বিশ্বায়ন বলতে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান একীকরণকে বোঝায়। এই একীকরণ আন্তর্জাতিক সীমানা আতক্রম করে মানবশ্রম এবং জ্ঞান-প্রযুক্তির অবাধ চলাচল ছাড়াও পণ্য, পরিষেবা এবং পুঁজির চলাচলে ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং বলা যায়, বিশ্বায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ধারণা, বিশ্বাস, পণ্য এবং পরিষেবার মতো বিষয়গুলো সারা বিশ্বে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বায়ন পৃথিবীর সমগ্র অধিবাসীদেরকে একটি বিশ্ব গ্রামে (Global village) এ পরিণত করেছে। এটি বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে কাছাকাছি এনেছে আর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল করে তুলছে। বিশ্বায়নে তিনটি মৌলিক উপাদান পরিলক্ষিত হয়। এগুলো হচ্ছে, পণ্যের অবাধ প্রবাহ, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং শ্রমের অবাধ প্রবাহ। অনেকের মতে, এটা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর বিকাশকে নির্দেশ করে। অনেকে মনে করেন, বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নবসংযোজন হলো বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের এই ধারা থেকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বলা যায়, নব্বই দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে শুরু হয়।
বিশ্বায়নের প্রভাব নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন, বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। অনেকে এর ভালো দিক যেমন খুঁজে পেয়েছেন, তেমনি খারাপ দিকের কথাও উল্লেখ করেছেন। পণ্ডিতেরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বেশকিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বা ফলাফল তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের দেশও পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ে সীমান্ত-বিহীন বাজারের সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের জিডিপি বেড়েছে। পোশাক শিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে কার্যকরী ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে।
বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশে বহুমুখী কোম্পানী এবং বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ থাকায় প্রচুর পরিমাণে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে দেশ-বিদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বায়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বহুলাংশে গতিশীল করেছে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতি সম্প্রসারণের ফলে এই দেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যদেশের নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর ফলে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য অপর দেশে যেতে বাধা নেই। বিভিন্ন দেশের দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছে।
এটি সম্ভব হয়েছে যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের মাধ্যমে। বাংলাদেশর জলপথ, আকাশপথ এবং অভ্যন্তরীণ চলাচলে বিশ্বায়নের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজে পৃথিবীর একস্থান থেকে অন্যস্থানে অডিও, ভিডিও, টেক্স আদান প্রদান করতে পারছি। বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরও পড়েছে।
বিশ্বায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সুযোগ পাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থাকায় সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো যাতায়াত ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন। অতীতের সেই সনাতন যানবাহনের জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক দ্রুত গতিসম্পন্ন যানবাহনের ব্যাপকতা বাংলাদেশে লক্ষ্য করার মতো। এতে আভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অধিক গতিশীল হয়েছে।
উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগ মাধ্যম এবং অতি আধুনিক পরিবহন সুবিধার প্রভাবে বিশ্ব অতি কাছাকাছি এসেছে। এখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে শিখতে ও জানতে পারি দূরতম অঞ্চলে বা দেশে কী ঘটছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একটি একক গ্রামের মতো হয়ে গেছে। তারা পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর মতো তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারে।
বিশ্বায়ন এখন মূলত একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের স্থানান্তর এখন তথ্যের একটি তাৎক্ষণিক এবং আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব তৈরি করেছে যার ফলে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টায়ই সারা বিশ্ব একটি ট্রেডিং নেটওয়ার্কে রয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যাংকিং ও আর্থিক কার্যক্রমকে অনেকাংশে পরিবর্তন করেছে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রা স্থানান্তর এবং ব্যবসার লেনদেন এখন কম্পিউটারের মাউস ক্লিক করার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখন ইলেকট্রনিক স্ক্রিনের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারি। ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশ্বায়নের ভূমিকা অপরিসীম। পারস্পরিক সহযোগিতা, বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতে ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেন থেকে শুরু করে ব্যাংক ও বীমার নানাবিধ ই-ক্যাশ, ই-ব্যাংকিং ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সেবার মান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্বায়ন খেলাধুলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিবছর অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজন করা হয় যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, অলিম্পিক গেমস ইত্যাদি। এই ইভেন্টগুলো স্যাটেলাইট দ্বারা বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার করা হয় এবং সারা বিশ্বের মানুষ সেগুলো সরাসরি দেখে। খেলার স্থানটি বিভিন্ন দেশের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। তারা একে অপরের কাছাকাছি আসে, তাদের মতামত এবং বন্ধুত্ব ভাগ করে নেয়। বাংলাদেশও এই সুযোগের সুবিধাভোগী।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিকে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বায়নের ফলে দাতা দেশগুলো আমাদের সাক্ষরতার হার এবং সামগ্রিক শিক্ষার অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি খাতে তাদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। এদেশের যুব সম্প্রদায়ের অনেকে দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে কর্মের সুযোগ পাচ্ছে। বিদেশ থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করছে। ফলে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার সমমানের এবং এদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি হচ্ছে, যার ফলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ সুগম হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে একদেশ থেকে অন্যদেশে মেধাবীরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। তারা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে দিনদিন পরিচিত হচ্ছে এবং বিশ্বের সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে তারা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। অনেকেই দেশে ফিরে এসে তাদের অর্জিত জ্ঞান অন্যদের শেখাচ্ছেন। ফলে আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানব সম্পদ রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বায়ন মানব সম্পদ উন্নয়ন ও রপ্তানিতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক সময় ছিল বোঝাস্বরূপ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে এখন বাংলাদেশের জনগণের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তারা ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে অন্যদেশে গমন করছে এবং দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখছে। যদিও বিশ্বায়ন মূলত ব্যবসা, বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত, তবে এখন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে বিশেষ করে সংস্কৃতির আদান প্রদানে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এবং ইন্টারনেট দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রথা ও আচরণ নিয়ে আসছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে, বৈশ্বিক সংস্কৃতি ক্রমশ স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্রমাগত মিথস্ক্রিয়া হয়। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অনেক বিদেশি সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও বিশ্বাস আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে অনুপ্রবেশ করছে। ফলে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই একে ভালো বলছেন আবার অনেকেই মনে করেন এর ফলে আমাদের নিজস্ব চিরায়ত সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের সমাজে বিশ্বায়নের কিছু নেতিবাচক ফলাফলের কথাও বরাবরই বলে আসছেন। যেমন, বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদশে সমাজ ব্যবস্থা অতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। পারিবারিক ভাঙন, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিচ্ছিন্নতা, প্রবীণ সমস্যা, মাদকাসক্তি, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে এদেশের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অধিক মুনাফা লাভের আশায় তাদের অধিকাংশ শিল্পকারখানা ও ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশে স্থাপন করেছে অথচ বিজ্ঞানসম্মতভাবে বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে না। পাশাপাশি নগরায়ণ ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণ করছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তি ও তাদের উন্নত পণ্যসামগ্রী রপ্তানির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ অনুন্নত বিশ্বে নব্য ঔপনিবেশবাদ ধাঁচে বাজার ও মার্কেট সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে।
বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত উন্নত জীবনযাত্রা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রভাব জনজীবনে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। মূল্যবোধের পরিবর্তনের ফলে সামাজিক অনুশাসন হ্রাস পাচ্ছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে উন্নত বিশ্ব বাংলাদেশসহ প্রান্তিক দেশগুলোতে অবাধে পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবা বিপণন করে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বা দেশীয় উৎপাদন, প্রযুক্তি ও সেবা খাত প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রুগ্ণ হয়ে পড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বকে সমন্বয় ও সমন্বিত করেছে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিতে পার্থক্য রয়েছে। কোনো দেশের সংস্কৃতি অন্য একটি দেশের জন্য অপসংস্কৃতি বলে প্রতীয়মান হতে পারে। সুতরাং বিশ্বায়নের ফলে অনেক সময় এরকম অপসংস্কৃতি আমাদের দেশের মূলধারার সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বায়নের সুফল পাচ্ছে এককভাবে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া উন্নত দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। ফলে ধনী দেশগুলোর সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলো ক্রমশ দরিদ্র হতে থাকে। এক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিজ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটায়। অনুন্নত দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধনী দেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এ কথা সত্য যে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশ্বায়নের প্রভাব ব্যাপক ও বহুধা বিস্তৃত। স্বল্প পরিসরে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক বিশ্বের এক অনিবার্য বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এ প্রভাব কখনও ইতিবাচক আবার কখনও নেতিবাচক। তবে বিশ্বায়ন মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক গতি এনে দিয়েছে। একদেশ থেকে অন্যদেশে যোগযোগ, যাতায়াত, পরিবহন, আমাদানি ও রপ্তানি, তথ্যের আদান-প্রদান অনেক সহজতর হয়েছে। সর্বোপরি উন্নয়নের চাকা দ্রুতগতিতে ঘুরছে। তবে সে উন্নয়ন সর্বজনীন বা সমতাভিত্তিক নয়। দরিদ্র দেশগুলো এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী