ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : অতীত ও বর্তমান

ড. এ. এইচ. এম মাহবুবুর রহমান
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : অতীত ও বর্তমান

চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অনেক সমস্যার মধ্যেও শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে একটি নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, ম্যাকআপম্যান, সুরকার, গীতিকার, নৃত্যপরিচালক, শিল্প নির্দেশক, সম্পাদক সবার যৌথ প্রচষ্টায় এ শিল্প টিকে থাকে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি মানুষের শ্রম মেধা এবং মননশীল চিন্তার প্রতিফলনে নির্মিত হয় একটি চলচ্চিত্র। বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের ভূমিকা ছিল গর্বের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রকারের এটিই ছিল প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ। ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত পোস্টার। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা হয়েছিল এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। এছাড়া জহির রায়হানের ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’, আলমগীর কবীর নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ (১৯৭১) বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ এবং ফখরুল আলম নির্মাণ করেন ‘জয় বাংলা’ (১৯৭২)। মুক্তিযুদ্ধের সময় আরও কিছু তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল। এর আগে পূর্ব পাকিস্তান আমলে আব্দুল জব্বার খানের ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) চলচ্চিত্র নির্মাণের অবস্থায় ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিএফডিসি (পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বিএফডিসি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন) নামে পরিচিত।

১৯৭২ সালে নির্মিত হয় কামাল আহমেদের ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, আকবর কবির পিন্টুর ‘পলাশের রং’, কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’, সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নীসাক্ষী’ চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ আনন্দের ‘বাঘা বাঙালী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ প্রমুখ চলচ্চিত্র ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ আলমগীর কবীরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ এবং আজিজুর রহমানের ‘অতিথি’ সদ্য স্বাধীন দেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির ঐতিহ্যনির্ভর চলচ্চিত্র।

১৯৭৪ সালে নারয়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’, এস আলীর ‘বাংলার ২৪ বছর’, আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’, ইবনে মিজানের ‘জিঘাংসা’, মহিউদ্দিনের ‘ঈসা খাঁ’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র আমাদের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি ইতিহাস হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর এদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে ইবনে মিজানের এক ‘মুঠো ভাত’, মোস্তাফিজের ‘মায়ার বাঁধন’, আলমগীর কবীরের ‘সূর্য কন্যা’, দিলীপ বিশ্বাসের ‘সমাধী’ ও রাজেন দরফদারের ‘পালঙ্ক’ সামাজিক আবেগনির্ভর শিল্পসমৃদ্ধ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত থাকলেও হারুন অর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ ছিল উল্লেখ করার মতো।

হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ ‘শ্যামল ছায়া’, তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’সহ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী চলচ্চিত্র এখান থেকে নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এসব চলচ্চিত্র ছাড়াও বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’, মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’, এহতেশাম-এর ‘এদেশ তোমার আমার’, সালাউদ্দিনের ‘রূপবান’, সাদেক খানের ‘নদী ও নারী’ ইবনে মিজানের ‘জরিনা সুন্দুরী’ কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘আলোর মিছিল’, আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বউ’ প্রমোদকর গোষ্ঠীর ‘দিন যায় কথা থাকে’সহ অসংখ্য শিল্পসমৃদ্ধ, নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আশির দশকে বিকল্প ধারা চলচ্চিত্র বা শর্ট ফিল্ম ফোরাম-এর আন্দোলনের ফলে নির্মিত হয় বেশকিছু শিল্পসমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। মশীহ উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর ‘সুর্য দীঘল বাড়ী’ (১৯৭৯), মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ (১৯৮৪), ‘চাকা’ (১৯৯৩), ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬), ‘দুখাই’ (১৯৯৭), ‘দূরত্ব’ (২০০৬), ‘খেলাঘর’ (২০০৭), তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ (১৯৮৪) ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ (১৯৯৯), ‘লাল সালু’ (২০০১), তারেক মাসুদের মুক্তির গান (১৯৯৫), ‘মাটির ময়না’ (২০০২), ‘অন্তর্জালা’ (২০০৬), আবু সাঈদের ‘শস্খনাদ’ (২০০৪), ‘নিরন্তর’ (২০০৭), গোলাম রব্বানী বিপ্লবের ‘স্বপ্নডানায়’ (২০০৭) চলচ্চিত্র শিল্পে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। এসব চলচ্চিত্রের গল্প, শিল্পীর আবেগ ক্যামেরা, আলোর ব্যবাহার আর পরিচালকের মুন্সিয়ানা এবং নান্দনিক নির্মাণ শৈলি দর্শক সমালোচক সবার কাছেই সমাদৃত হয়।

নব্বই-এর দশকে নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণে এসে জনপ্রিয় কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। হুমায়ূন আহমেদের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘শস্খনীল কারাগার’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মোস্তাফিজুর রহমান ‘শস্খনীল কারাগার’ (১৯৯২)। চলচ্চিত্রটি সুধীমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি পারিবারিক আবহের মধ্যদিয়ে সুন্দরভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেন হুমায়ূন আহমেদ। বস্তনিষ্ঠ গল্প আর মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা নিটোলভাবে ওঠে আসে চলচ্চিত্রটিতে। হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে সমাজের সুখ দুঃখ, যাপিত জীবনের গল্প আর পারিবারিক মেলোড্রামা নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়। ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯), ‘দুই দুয়ারী’ (২০০০) ‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩), ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৫)। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে বেলাল আহমেদ নির্মাণ করেন ‘নন্দিত নরকে’ (২০০৬), তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন ‘দ্বারুচীনি দ্বীপ’ (২০০৭), শাহ আলম কিরণ নির্মাণ করেন সাঁজঘর (২০০৭)। বছর দুই বিরতি দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আবার নির্মাণ করেন ‘আমার আছে জল’ (২০০৮) ‘প্রীয়তমেষূ’ (২০০৯) এবং ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ (২০১২)। চলচ্চিত্রে পরিবার ও সমাজের নানা বিষয় চিত্রিত হয়। মানুষের আবেগ প্রকাশের নানা মাত্রা থাকে। গ্রামের সহজ-সরল খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের আর্থসামাজিক, মানষিক যন্ত্রণা ক্লিষ্ট বিষয় হুমায়ূন আহমেদ সাবলীলভাবে আলো দিয়ে লিখে ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। ক্যামেরার চোখে মানুষের দুঃখ ওঠে আসে, বেদনার ভাষা শোনা যায় রুপালি পর্দায়। পরিচালক থাকেন নৈর্ব্যক্তিক। ইমেজ জীবন্ত হয়ে ওঠে পরিচালকের দক্ষতায়।

বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্র থেকে মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন আর শিল্পমান নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না। পরিবার নিয়ে হলে গিয়ে কেউ চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চায় না। এ অবস্থায় ওয়েব সিরিজে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য নেট দুনিয়ায় তরুণ নির্মতারা ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করছে বেশি। ২০১৬ সালে অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’ কিংবা তৌকির আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’, মেহের আফরোজ শাওনের ‘কৃষ্ণপক্ষ’, আব্দুল আজিজের নিয়তি, ‘শিকারি’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র ছিল নান্দনিক ও দর্শক নন্দিত। ২০২১ সালে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত ‘রেহেনা মরিয়ম নূর’ দেশে দর্শক নন্দিত না হলেও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে। জিতে নিয়েছে নানা পুরস্কার। সম্প্রতি সিনেমা হলে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি চলচ্চিত্র মুর্তজা আতাশ জাম জাম পরিচালিত ‘দিন : দি ডে’, রাইহান রাফি পরিচালিত ‘পরাণ’ এবং ‘সাইকো’ দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। ওটিটিতে মুক্তিপ্রাপ্ত যে ওয়েব সিরিজগুলো দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে এগুলোর মধ্যে ‘মহানগর’, ‘কায়জার’, ‘রিফুজি’, ‘সাবরিনা’, ‘সম্পূর্ণা’, টিকটিকি অন্যতম।

লেখক : শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ

সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত