ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সৌন্দর্য, সততা ও নিষ্ঠা

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
সৌন্দর্য, সততা ও নিষ্ঠা

যা কিছুই আমি করি না কেন তার মধ্যে সৌন্দর্য, সততা, নিষ্ঠা ও নিয়মতান্ত্রিকতা থাকার আবশ্যকতা আমার স্বার্থেই রয়েছে। আমার কাছ থেকে সমাজ, সংসার, দপ্তর ও দেশ সব সময় ভালো কিছুই আশা করতে পারে। আমারও উচিত আমার ভাল কিছুই ডেলিভারি করা। আমার পদবি, পর্যায় এবং অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আচার-আচরণই আমার থেকে প্রত্যাশিত। সুতরাং পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চলন-বলন সম্পাদন নিয়ন্ত্রণ অনুধাবন প্রক্ষাপন প্রকাশ পাওয়া উচিত। সব কাজে যথাযথ সচেতনতা গাম্ভীর্য ও মর্যাদাবোধকে মেনে চলা উচিত। আমার অনাবধানতা অজ্ঞতা কিংবা অবজ্ঞা দ্বারা আমি নিজে, আমার সংসার, সমাজ, দপ্তর ও দেশ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়- যেন বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমার কাছ থেকে সময় ও সমাজ যতখানি নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা প্রত্যাশা করে, তা পূরণে আমার চেষ্টা অবশ্যই থাকতে হবে। এ ভাবেই আমি যদি আমার কাছে জবাবদিহির পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে সার্থক হবে আমার পথচলা এবং আমার দ্বারা উপকৃত হবে দেশ সময় ও সমাজ।

পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক দাপ্তরিক সব বিষয় সামগ্রিকভাবে মন-মানসিকতার ওপর প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে সক্ষম । আবার মন-মানসিকতার সার্বিক সুস্থতার ওপরই পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক দাপ্তরিক সব পর্যায়ে বলিষ্ঠ পদচারণার প্রকৃতি ও সুযোগ নির্ভর করে। অর্থাৎ এরা একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে ভালো, সুস্থ ও সাবলীল করতে ও পেতে উপযুক্ত মন-মানসিকতাও থাকতে হবে। আবার মন-মানসিকতার সার্বিক সুস্থতা ও সমৃদ্ধির জন্য ভারেলা পরিবেশ থাকতে হবে। দুটিই আপেক্ষিক। অতএব, তা নিয়ন্ত্রণ তদারকি, পোষণ ও তোষণে সজাগ সদা সচেতন থাকতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান, বয়স, পদমর্যাদা, প্রায়োরিটি অনুযায়ী ছোটখাটো ব্যাপারগুলোতে সময় ব্যয় বা মন নিবদ্ধ করা অনুচিত। বড় কাজের জন্য বড় মন বড় প্রত্যাশা ও বড় আয়োজন প্রয়োজন। থাকা চাই সুনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও মনোনিবেশ। ছোটখাটো ব্যাপারে ব্যাপৃত হওয়াতে মন ছোট হয়- সময়, ক্যালরি, এনার্জি সবই অপব্যয় হয়। দরকার নেই। কাউকে কৌশলে ঘায়েল করার জন্য বুদ্ধি আঁটতে গিয়ে কিংবা কীভাবে কাউকে, এটাকে, সেটাকে বেকায়দায় ফেলা যায় সে চিন্তায় সুচিন্তারা অস্থিরতায় ভোগে। অতএব তা পরিত্যাজ্য। এটা সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত সত্য যে, উন্নত হতে হলে নত হতে হবে আগে। কারও উপকার করা মানে নিজে উপকৃত হওয়া আর কারও ক্ষতি করা মানে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পথ প্রশস্ত করা।

ঈমান অর্থ আল্লাহর ওপর আস্থা বা বিশ্বাসী বা নির্ভরশীল হওয়া বা থাকা এটি একটি সাধারণ কথার কথা হতে পারে না। ঈমানদার ব্যক্তির জন্য অনেক ফজিলত ও উপকার বা পুরস্কার এর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এটিও শুধু কথার কথা না। ঈমান রাখা বা অবলম্বন করা বা অর্জন করা সাধারণ একটি ব্যাপার না। এর জন্য সাধনা প্রয়োজন। যে কোনো সাফল্য অধ্যয়ন অধ্যবসায়ের দ্বারাই অর্জিত হয়, এর জন্য আন্তরিক সদিচ্ছা থাকতে হয়। নিজের অভিপ্রায় উদ্দেশ্য বিধেয় সুস্পষ্ট থাকতে হয় বা করতে হয়। কোনো সাফল্য আপনা আপনি এসে ধরা দেয় না। ‘আল্লাহর ওপর যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান’- কাজী কবির আক্ষেপ বা প্রক্ষেপ যথেষ্ট তাৎপর্যবাহী। ‘পূর্ণ ঈমান’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাফ হার্টেড সাদা মাটা দোদুল্যামানতা যখন যেমন তখন তেমন হেলা খেলার ব্যাপার নয় ঈমান। ‘মুসলমান’ একটি সাধারণ শব্দ নয়- আল্লাহর ওপর পূর্ণাঙ্গ নিঃশর্ত নিরঙ্কুশ ও নির্ভেজাল আত্মসমর্পণকারীই হচ্ছে মুসলমান। সুতরাং যে তার সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সচেতনভাবে যত্ন সহকারে বন্দেগি ও বন্ধুত্ব সংস্থাপন করেছে- তার তো দুশ্চিন্তা সংশয় সন্দেহ থাকে না। যে কোনো ব্যাপারে সে কাজ করে যাবে অনবরত নিঃসংকোচে সুচারুরূপে, টাল্টি বাল্টি তার কাছে পাত্তা পাবে না- সবসময় আল্লাহর মর্জির ওপর যার ভরসা এবং আল্লাহকে রাজি খুশি করানোর কথা স্মরণ রেখে যে কাজ করবে তার আবার দুশ্চিন্তা থাকবে কেন? সে তো কাজ করে যাবে নিত্যনতুন উদ্যমে- চির জাগ্রত শিরে, আত্মবিশ্বাসে।

মানুষ দুনিয়াদারির শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও নিরাপদ সাফল্যের জন্য যার যার মত সৃষ্টি কর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে দোয়া ও মোনাজাত করে আর তাঁর প্রেরিত মহাপুরুষদের প্রতি সালাম ও দরুদ পাঠ করে সাফায়াত বা সুপারিশ প্রার্থনা করে- প্রত্যাশা করে নিরাপদ ও নিরাময়ের। অনেকে মনে করেন এ প্রার্থনা ও প্রত্যাশা শুধু মুখে মুখে। বিপদে পড়লে প্রভুকে স¥রণ করা, আর বিপদ থেকে পরিত্রাণ লাভের পর আর তার কথা তেমন একটা মনে আসে না। আসলে প্রভুর হুকুম আহকাম পালন হয় কি-না সে বিচার বিবেচনা বড় একটা আসে না। শুধু তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া, প্রেরিত পুরুষদের সাধু-সন্তদের সাফায়াত চাওয়া। কীভাবে চললে আমরা শান্তি পেতে পারি, নিরাপদ থাকতে পারি, সাফল্য লাভ করতে পারি, বিপদ এড়িয়ে চলতে পারি, কোন কাজে কল্যাণ আর কোন কাজে অকল্যাণ তা বাছ-বিচার করি না- আমল করি না। আর তা করি না বলেই শান্তি পাই না, নিরাপত্তা লভি না, বিপদাপন্ন হয়ে পড়ি, স্বাস্থ্য হারাই, সম্পদ হারাই, সাহস হারাই, হিম্মত হারাই, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি দিগি¦দিক শূন্য হয়ে হাহুতাশ করি। আর মুখে মুখে তার কাছে সাহায্য চাই। পরিত্রাণ চাই। অলৌকিক সাহায্যের প্রত্যাশায় বসে থাকি। পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়াশুনা করি না- অথচ দৈব মেধাশক্তি এসে যেন আমাকে পরীক্ষা তরণী পার করিয়ে নেয় সে আশায় বসে থাকি। নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের কাছে জবাবদিহির ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিই না অথচ ভাবি আমি যেন অদৃশ্য এক সাহায্যদাতার সাহায্যে আমার যাবতীয় অন্যায় অপকর্ম থেকে নিস্তার নিষ্কৃতি লাভ করি। অথচ আমরা কিতাব পাঠ করি সুর করে, না বুঝে এবং তা অনুসরণের কোসেস না করে। বল ও ব্যাটের সমন¦য় না হলে ক্রিকেটে যেমন রান ওঠে না- চিন্তা, বিশ্বাস ও কর্মের মধ্যে সমন¦য় না হলে সিদ্ধিলাভ হবে না- হতে পারে না।

বয়স বাড়লে অভিজ্ঞতা বাড়ে এবং সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন সহজতর হয়, কম সময় ও শ্রমে বেশি কাজ করার ফলাফলও পাওয়া যায়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধৈর্য, কর্ম উদ্যম, শক্তি ও সাহসেও ভাটা পড়ে। শ্রান্তি আসে ক্লান্তি বাড়ে। অবসাদের আত্মীয়রা এসে বাসা গাড়ে। দৃষ্টি, শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়- নানান রোগবালাই শরীরকে কর্মণ্ডঅক্ষম করে তোলে।

ফলে অভিজ্ঞতার দ্বারা একদিকে যে বাড়তি লাভ হয় এসব অনিবার্য অতিথির আগমনে ক্ষতি বাড়তেই থাকে। ফলে ফলাফল প্রায় পূর্ববতই থাকে। তাও আবার অর্থনীতির সেই অনিবার্য শর্ত- ‘আর সব যদি ঠিক থাকে’। অর্থাৎ পরিবেশ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা এবং নিজের মনোবল বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তাশক্তির ন্যূনতম সজাগ পরিস্থিতি ঠিক ঠাক থাকলেই না উপরে যা বললাম তা সাধিত হতে পারে। এসব বাস্তব বিষয় বিবেচনায় এনেই বলি- মনরে! সময় থাকতে হও সাবধান। শরীরের যত্ন নাও, মনকে ভালো খাবার দাও, পরিবেশকে বান্ধব করে তোলার পদক্ষেপ নাও অহেতুক ঝামেলা ঝক্কি-ঝামেলায় বকাঝকায় নিজের বল-বুদ্ধি মন ও মনোযোগকে অবচয়, অপচয় ও অপব্যবহার না করে পজিটিভ চশমা পরো, নেগেটিভ ভাবনা ছাড়, নিয়মতান্ত্রিকতায় ঘাঁটি গাড়। উদার-উন্মুক্ত প্রকৃতির কাছে ফিরে যাও, তার থেকে শক্তি সাহস ও শান্তির প্রেরণা নাও, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে, শ্রাবণের জোয়ারে নদীর পথচলা, পাখির কূজনে, কুহেলি কুয়াশায় ঢাকা শীতের ভোর, শরতের নির্মেঘ আকাশ, কৃষ্ণচূড়া, বাগান বিলাস আর আজালিয়ার সৌন্দর্যে মুখ লুকাও, শ্বাস-প্রশ্বাস নাও। শান্ত সকালের মেধাবী প্রহরে সৃজনশীলতায় হও সমর্পিত চিত্ত। পশু পাখালির নিত্যদিনের সাংগীতিক জাীবনযাত্রায় কান পেতে শোন- তাদের সবার সঙ্গে একাত্ম হও। এরা সবাই বিধাতার, বিধাতাও এদের সবারই। মনের সব জড়তা, কূপমণ্ডূকতা, দীনতা, হীনতা, ঝেড়ে মুছে ফেল, নির্ভার করে তোল তাকে। হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, রাগ, ক্ষোভ, ভয়, আশঙ্কা, সংকোচ, শঙ্কা, সংক্ষুব্ধতা সবই কর পরিত্যাগ। নিত্যনতুন উদ্যমে গৌরব প্রত্যাশায় উদ্বেল হয়ে ওঠো। ঊহলড়ু ঃযব ষরভব ধহফ যবষঢ় ঃড় সধশব রঃ ষড়হম.

জীবনের প্রতিটি দিন নতুন নতুন অবয়বে হাজির হয়। সেকারণে সফলতা ব্যর্থতার খতিয়ান টেনে আনন্দ কিংবা বিষাদে নতুন দিনের আলিঙ্গনকে দায়িত্বহীন করা সমীচীন নয়। নামাজ পাঠে সব সময়ই প্রভুর সমীপে আত্মসমর্পণের মানসিকতা জাগ্রত থাকা উচিত। জীবনে ভুলভ্রান্তি অন্যায় ভালোমন্দ থাকবেই। নিত্য এটি যেহেতু প্রশিক্ষণ ও অর্জনের পালা সেহেতু ভালোমন্দের মাঝেও অব্যাহত থাকবে প্রয়াস। অজানা আশঙ্কা উদ্বিগ্নে ভোগার কোনো দরকার নেই। প্রতিদিনের জীবনকে নতুন অর্থে অর্থবহ করে তোলা দরকার। হিসাবের খতিয়ান মিলবে জীবনের শেষে দিন একভাবে কেটে যাবে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠারহিত, দুশ্চিন্তাহীন জীবনযাপনে নিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ী জীবন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থাকবে সর্বদা। সে লক্ষ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আশঙ্কা দুর্ভাবনায় আকর্ণ হয়ে নয়, আশাবাদী ও সৃজনশীল হয়ে। প্রচেষ্টা ঠিক ও অব্যাহত থাকলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হয়েছে কি কোনোদিন? তবে?

মানুষের জীবনের স্থিতিপত্রের দর্শন শুধু মোদ্দা কথায় বকবক করে বললে বলার বা প্রকাশের উদ্দেশ্য পূর্ণতা পাবে না। একে দর্শন হিসেবে শিল্পকলার মাধ্যমের শক্তিশালী সব শাখায় ফুটিয়ে তোলা বাঞ্ছনীয় হবে। ছোটখাটো কাজে, আলাপ আলাপনে, ব্যবহার বক্তব্যে, উক্তি উপলব্ধিতে, সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনযাপনে সর্বত্র তার প্রকাশ চাই। প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চাই- সে ভাবনার কায়িক ও অবয়বগত প্রকাশে। আর এর জন্য প্রয়োজন নিবিড় দর্শন। সময় ও সুযোগের অপব্যয়ের অবকাশ নেই। সত্য আবার একে মনের বোঝা ভেবে রেখে হতাশ হওয়ার কারণ দেখি না। মুক্ত হতে হবে সংকোচ ও বিহ্বলতা থেকে। আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বোধের সজীব সতেজ প্রকাশ প্রয়োজন। সব কাজে আগ্রহ ও সুচিন্তা, সযত্নের ছাপ রাখতে হবে। মনকে বিশ্রাম দিতে হবে সবল চিন্তার দোসর হওয়ার জন্য।

কেউ কোনো এক সচেতন অবসরে যদি তার অতীতের দিকে তাকায় তাহলে সে দেখতে পায় কত বিচিত্র অবয়বে তার এই পথচলা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে সে এগিয়ে চলেছে অনাগত ভবিষ্যতের পানে। শূন্য থেকে যাদের শুরু তারা যদি বিয়োগ করে তার বর্তমানকে তাহলে বেরিয়ে যাবে অর্জনের প্রকৃত খতিয়ান। এই প্রাপ্তি এই অর্জন কতটা বৈষয়িক কতটা ন্যায়সঙ্গত ও সহজাত তার বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার। কোনো প্রতিজ্ঞা বা কোনো প্রত্যয় তাকে এই অভীষ্ঠে এনে দিয়েছে তারও শুমারি প্রয়োজন। তার সহচর্যে যারা এসেছে তাদের সঙ্গে সে কেমন আচরণ করেছে তার কাছ থেকে কি তারা পেয়েছে তার পর্যালোচনা তাকে করতে হবে। তাই যদি সে করে তাহলে সে দেখে অনেকের হৃদয়ে হয়েছে তার ঠাঁই আবার অনেককে দিয়েছে মর্মাঘাত। এ সবের শুমার করণে তাকে প্রত্যয়দীপ্ত হতে হয় ভবিষ্যতের জন্য। আর এর থেকে সে প্রেরণা পেতে পারে আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল মানবতাবাদী ও পরোপকারী হওয়ার।

মানুষের ভেতরের ভাবনা এবং বাইরের বাস্তবায়নের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। অন্তরের বিতৃষ্ণ ঘৃণা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাহিরের আচরণে প্রকাশ পায় এটা স্বাভাবিক। সুতরাং অন্তরের বিষয় আশয়কে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন না করে বাইরের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ ও সুশীল করতে চাইলে তা হয় বোকামি এবং নীতিশাস্ত্রের বিবেচনায় তা হয় ভ-ামি। এ ধরনের প্রয়াস সুফল বয়ে আনতে পারে না। মনে যে সব বিষয় আশয় ঘোরাফেরা করে, তাদের একটা শ্রেণিকরণ, বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও বিচার বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। জন্মগত বা সহজাত ভাবে কিছু প্রবণতা সেখানে থাকেই। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজসাধ্য হয় না, তবে সাধ্যের অতীতও নয়। সুচিন্তিত ও সুশিক্ষা ও আত্মণ্ডউপলব্ধি আত্মসমালোচনার নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে তার বেশ কিছু সংশোধন ও পরিমার্জন করা সম্ভব। আল কোরআনে, বাইবেলে, ত্রিপিটকে, বেদে, উপনিষদে অর্থাৎ সব ধর্ম ও শাস্ত্রে একথা বলা হয়েছে স্পষ্ট করে যে, যে নিজেকে চিনতে শিখেছে বা আত্মসমালোচনা করতে জানে সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান।

সুতরাং নিজেকেই নিজের সমালোচনা করতে হবে। চিহ্নিত করণের চেষ্টা চালাতে হবে নিজের দোষ ত্রুটি, প্রবনতার ভালো ও মন্দ দিকগুলোকে। কীভাবে কোন মুহূর্তে তা চিন্তা ও কর্মকে প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রিত করছে তা দেখতে হবে। দেখা যায় এক ধরনের বিতৃষ্ণা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এবং অন্তর্মুখিতা অধিকাংশ আচরণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। সীমাবদ্ধ চিন্তভাবনা এবং সংশয় সন্দেহ ও বহুমুখী কিছু অপয়া ধ্যান-ধারণা সুচিন্তার সুযোগকে করছে সীমাবদ্ধ। মনকে আচ্ছিন্ন রাখছে অন্য চিন্তায়। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আমাদের অগোচরে ও অমনোযোগিতায় বিনষ্ট হয়। অনেক তাৎপর্যহীন বিষয় এসে তাৎপর্য পূর্ণতাকে আমাদের থেকে দূরে সারিয়ে রাখে। প্রকৃত পক্ষে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্থায়িত্ব কোনটির বেশি কিংবা বেশি দরকারি সেটি উপলব্ধির সীমানায় আসতে যথেষ্ট দেরি হয়। বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে তা বারে বারে বিভিন্ন অবয়বে আমাদের চিন্তা-চেতনায় ধরা দেয়। অদরকারির বেড়াজাল ছিন্ন করে, গুরুত্বহীনের গহ্বর থেকে গুরুত্ববহকে বের করে এনে মনোযোগ ও কার্যকারিতায় ঠাঁই দেওয়াটাই দিতে পারাটাই বিশেষ বিবেচনায় আনা উচিত।

আমরা অনেকেই হয়তো অধিকাংশ সময় অকাজের পেছনে অধিক সময় ব্যয় করে ফেলি। কাজের জন্য সময়ের বরাদ্দ কমে যায় তাতে কর্মস্থলে বিরূপ পরিবেশ, অন্যায় আবদার, অপকর্ম, ষড়যন্ত্রকে অধিক আমল দিতে গিয়ে সে চিন্তা-চেতনায় অধিকাংশ সময় আচ্ছন্ন থাকতে গিয়ে নিজের অনেক অমূল্য সময়কে হারিয়ে ফেলি। অথচ আমাদের ওই অহেতুক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কিংবা মনোযোগের মূল্যবান সময় ব্যয়ে কোনো তাৎপর্যবাহী অর্জন নেই। অন্যের চরিত্রচারিত্রের গোষ্ঠী উদ্ধারে গিয়ে সময় বিনষ্ট করার অবকাশ যত কম হয়, তত মঙ্গল। কেননা সেগুলো নিতান্তই সাময়িক এবং তাকে কেন্দ্র করে কোনো মহৎ স্থায়ী এবং কালোত্তীর্ণ কিছু করা সম্ভব নয়।

স্রষ্টার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণের অন্ত নেই। এ পর্যন্ত এসেছি- শারীরিক সাংসারিক বৈষয়িক ঐহিক ও পারিত্রিক যেটুকু সঞ্চয় ও সাফল্য তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। মানুষ যদি তার শৈশব কৈশোর যৌবন ও পূর্ববর্তী জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকায় তাহলে স্পষ্টতই বুঝতে পারে কীভাবে সে বড় হয়েছে। তার পেছনে যে অতীত তা অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসার অতীত। দারিদ্র্য, শোষণ-বঞ্চনার ভেতর দিয়ে কষ্ট যাতনা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যারাজি মোকাবিলার মাঝ দিয়ে তাকে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। তাকে দেখতে হয়েছে অনেক কিছুই। সইতে হয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু সব পর্যায়ে বিধাতার, যিনি অতিশয় দয়ালু ও দাতা, তার দয়া, মেহেরবানি ও সাহায্যে সে এগুলো পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। সে যদি মনে করে তার বিপদ দিনগুলোর কথা, জটিল পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভের কথা, সফলতার ব্যর্থতায় ভরা দিনগুলোর কথা, কত উপলক্ষ্যে কত শতজনের সঙ্গে লেনদেন ও আচার ব্যবহারের কথা তাহলে সে বুঝতে পারবে- তার উপলব্ধি জাগবে সে এখন এখানে কীভাবে এসেছে।

আল্লার ওপর পূর্ণ ঈমান রাখা ব্যক্তির বৈষয়িক বা ইহলৌকিক লাভ-লোকসান নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কোনো কারণ দেখি না। এটি হলে এটা হবে না, ওটা হবে- এসব বিবেচনায় নিজের বিশ্বাস বা ঈমানের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করার বিষযটিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। লোকে কী ভাববে এ চিন্তা নয়, কীভাবে নিজের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বজায় রাখা যাবে- কেননা বড় ক্ষণস্থায়ী এ সময়ে যা এখানে করছি সেটিই মুখ্য বিষয় হবে ফলাফল অর্জনের। সুতরাং কোনো প্রকার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ নয়- প্রার্থনা তাঁর কাছে তিনি যেন সৎপথে থাকার, পাওয়ার পথ ও পন্থাকে সহজ করে দেন। নিজের মানমর্যাদা সম্মান সচ্ছলতা সহনশীলতা একমাত্র তিনিই এনায়েত করতে পারেন। সুতরাং জাগতিক কোনো বাছবিচার মন্তব্য বিবেচনা দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগী হওয়া নয়। মাথায় এ চিন্তা সারাক্ষণ রেখে অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দূরে সরে যেতে দেওয়া নয়।

সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত