দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। সে সময় তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন। খুব কাছ থেকে অনুভব করেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট। আর পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের প্রতি জুলুমণ্ডনির্যাতনের প্রতিরোধের আন্দোলনে তিনি তো সম্মুখযোদ্ধা। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু সবসময় শান্তিপূর্ণ আইনানুগ সমাধানের নীতি গ্রহণ করেন।
সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বরাবরই সক্রিয় ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীনের পিকিং শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। ‘আমার দেখা নয়া চীন’-এ ফুটে উঠেছে সেই বর্ণনা, ‘অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে, আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ায় আজ যারাই শান্তি চায়, তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি। রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই। কারণ যুদ্ধে দুনিয়ার যে ক্ষতি হয়, তা আমরা জানি ও উপলব্ধি করতে পারি; ...মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য- যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।’
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি বলেছিলেন, ‘কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব- এ নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী।’ এটিই পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি হিসেবে নির্ধারিত হয়।
স্বাধীনতা কেবল অর্জনই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ কীভাবে যাত্রা করবে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী হবে, রাজনৈতিক জীবনপ্রবাহের নানা ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যৎ দূরদর্শিতায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি। বঙ্গবন্ধু সারাজীবনই ছিলেন অহিংস, মানবপ্রেমী, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর শান্তিপ্রিয়। তাই তাঁর পররাষ্ট্র নীতিতেও প্রাধান্য পেল, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ প্রতিপাদ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করল স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি। তিনি চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো জোট নয়, বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ দেশ, হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। সবার সঙ্গে আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ, অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিভিন্ন সীমানার প্রতিটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ কাজটি খুব সহজ ছিল না। কারণ, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবেশী ভারত সর্বোতভাবে সাহায্য করে। ভারতের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের জন্য বারবার ভেটো দিয়েছে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে গণহত্যায় সাহায্য করে। সুতরাং অনেকের ধারণা ছিল সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সোভিয়েত ব্লকের অনুসারী হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী জ্ঞান, ধীশক্তি ও স্বাধীনচেতা হৃদয়ের প্রতিফলন ঘটে বাংলাদেশের ‘জোটনিরপেক্ষ’ জোটে সদস্যপদ অর্জন এবং ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ এমন পররাষ্ট্র নীতিতে, যা আজও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি ও মূলমন্ত্র। তার কূটনৈতিক দর্শন ছিল অত্যন্ত তীক্ষè ও প্রখর।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রত্যাশিত সহযোগিতা মেলেনি চীনের কাছ থেকে। তবে সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম দেশ এখন চীন। এর অর্থ হচ্ছে দেশের স্বার্থে কূটনৈতিক পাড়ায় কোনো রাষ্ট্র চিরকালীন বন্ধু বা শত্রু নয়। এ যাবৎকালে বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগীদের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে চীন। আবার, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে ভারত। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থীদের আশ্রয়দানসহ সম্মুখসমরে ভারতের অনেক সৈন্যও প্রাণ হারায় অর্থাৎ নানাভাবেই ভারতের সহযোগিতা সবসময় মনে রাখবে বাংলাদেশ। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও পুনর্গঠনে ভারতের কাছ থেকে সবধরনের সহযোগিতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এদিকে ভারত ও চীনের বৈরী সম্পর্কের কথাও কারও অজানা নয়। তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ দুটির সঙ্গে সমানতালে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এটি সম্ভব হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভারসাম্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির জন্যই।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তাঁর পরিকল্পনা ছিল সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লিতে ফিরে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন ভারতের শক্তিশালী অবদানের কথা। বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের ভ্রাতৃত্ববন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নীতির মিল প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা হচ্ছে আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের মিল।’ তবে এর মানে এই নয় যে, তিনি অন্ধভাবে ভারতের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। তা বোঝা যায় লন্ডন থেকে বাংলাদেশে তার প্রথম যাত্রা দিয়েই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লিতে আসেন।
স্বাধীনতার সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল, তা ঠিক বলা যাবে না। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব- এই দুই বলয়ে বিভক্ত ছিল পুরো বিশ্ব। এর ফলে অহেতুক অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। আবার, আন্তর্জাতিক মহলের কেউ কেউ আমাদের টিপ্পনিও কাটত। তাদের দৃষ্টিতে আমরা ছিলাম বেপরোয়া। কেননা, সে সময়ে পাকিস্তানের মতো দেশ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তাদের ধারণা ছিল, এতে আমাদের কপালে আমরা কুঠার মারলাম, ভবিষ্যতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোরও কেউ কেউ ব্যথিত ছিল। তাদের মতে, বাংলাদেশ হয়তো মুসলিম বিশ্বে বিভক্তি সৃষ্টি করবে। কেননা, পাকিস্তানের মতো বড় মুসলিম দেশ থেকে বের হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দাঁড়ানো মুসলিম উম্মাহর একতাবদ্ধতার বিপরীত। এ কারণে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও পরিচিত ও সুসম্পর্ক থাকা অনেক মুসলিম দেশের স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের প্রতি চীনের বিদ্বেষী নীতি কার্যকর থাকে। ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু চীনের বিরোধিতায় ১০ আগস্ট তা নাকচ হয়ে যায়। এ নিয়ে ক্ষোভও ঝরে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বলেন, ‘ইতিহাস বড় তাৎপর্যপূর্ণ। যখন চীনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া হতো তখন এই বাংলার মানুষই বিক্ষোভ করত। আমি নিজে ওই ভেটোর বিরুদ্ধে বহুবার কথা বলেছি। যে ভেটোর জন্য চীন ২৫ বছর জাতিসংঘে যেতে পারে নাই, দুঃখের বিষয়, সেই চীন ভেটো ‘পাওয়ার’ পেয়ে প্রথম ভেটো দিল আমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও আমি কামনা করি তাদের বন্ধুত্ব। অনেক বড় দেশ। দুশমনি করতে চাই না। বন্ধুত্ব কামনা করি। কারণ আমি সকলের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু জানি না, আমার এই কামনায়, আমার এই প্রার্থনায় তারা সাড়া দিবেন কি না। যদি না দেন কিছু আসে যায় না। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা এত ছোট দেশ নই। বাংলাদেশ এতটুকু নয়। পপুলেশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র।’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতি ফুটে ওঠে। আরও কৌশলী ও সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সময়েই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনা রেডক্রসের একটি দল সফর করে বাংলাদেশের বন্যার্ত অঞ্চল। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় এক মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা। আর স্বীকৃতি না দিলেও পঁচাত্তরের মে মাসে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা আমাদের স্বপক্ষে ছিল না। যদিও সে দেশের বহু হৃদয়প্রাণ ব্যক্তিত্ব অনেক আইনপ্রণেতা ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের যুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করেছেন, যুদ্ধাগ্রস্ত দেশের মানুষের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেছেন। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই তো লিখে ফিললেন বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সেই মার্কিন মুল্লুকের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিলেন। স্বাধীনতার দু-তিন বছর পর্যন্ত আমেরিকার মন গলাতে বেগ পোহাতে হয় বাংলাদেশকে।
শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় অল্প সময়েই সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক মহলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দরবারে শান্তির মডেল হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব পরিষদের প্রেসিডেনসিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে এই পদকের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা পুরো বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। ১৯৭৩ সালের মে মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দু’দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদক পরিয়ে দেওয়া হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিজের দেশের মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবেননি, তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন বিশ্বের নিঃস্ব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বটা দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে শোষক, অন্যভাগে শোষিত। আমি শোষিতদের দলে।’ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো ধর্ম বা বর্ণের মানুষের ওপর শোষণ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি। মূলত বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন বিশ্বনেতা, যিনি সবসময়ই শোষিতদের পক্ষে কথা বলতেন। তাঁকে তুলনা করা হতো হিমালয়ের সঙ্গে। তিনি আফ্রিকার বর্র্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন; অবসান চেয়েছেন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিদেশি শাসনের। বঙ্গবন্ধু যেমন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, তেমনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সাইপ্রাস সরকারকে উৎখাতের নিন্দাও করেছেন। ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমাবাজি বন্ধের দাবিও জানায় বাংলাদেশ তার আমলেই। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার আগের পুরোটা সময় তিনি উল্কার মতো ছুটে চলেছেন বিশ্বজুড়ে। নিজে যেমন বাংলাদেশের উন্নয়নের মিশন নিয়ে ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশ, তেমনই বাংলাদেশেও এসেছে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, সরকার প্রধানরা।
আদর্শগতভাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত অবিচল; কিন্তু একই সঙ্গে দেশের সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিত করতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদী। আর এ জন্য তিনি সর্বজনীন মূল্যবোধ ও নীতির ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা এমন একটি সমাজের মানুষ, যেখানে সুদূর অতীত থেকেই, ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার বা ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবেরও আগে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কবি চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’, কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’- এসব লেখায় আমরা সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য পাই। চণ্ডীদাসের এ দর্শনতত্ত্ব বাঙালির মনন ও মানসের এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী উচ্চারিত হয়েছে। মানবতাই সবার ঊর্ধ্বে- তেমনি এক আলোকিত পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসেছেন শেখ হাসিনা। তিনি এমন এক পরিবার থেকে এসেছেন, দেশ ও মানবতার জন্য আত্মত্যাগ যাদের অপরিসীম। তার পিতা সারাটা জীবন অতিবাহিত করে গেছেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য যাকে জেল খাটতে হয়েছে জীবনের দীর্ঘ সময়। তিনি চেয়েছিলেন একটি শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র, যেখানে সবার জন্য সমানাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ, যার মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, শান্তি-সমৃদ্ধি এবং জননিরাপত্তা; যেখানে থাকবে না ক্ষুধা-দারিদ্র্য, শোষণ এবং অবিচার। এহেন একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে যখন বঙ্গবন্ধু আত্মনিয়োগ করেছেন তার সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যা করে পরাজিত পাকিস্তানিদের দোসর এ দেশীয় ঘাতকচক্র। ওই ভয়াল হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা কেবল তার পিতাকেই নয়, হারান পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে; এমনকি তার ১০ বছরের ছোট্ট শিশু ভাইকেও রেহাই দেয়নি খুনিরা। শুধু তিনি নিজে এবং তার ছোট বোন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সারাবিশ্বে আর কোনো দেশে এমন একজন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি নিজের সর্বস্ব হারিয়েও দেশের আপামর জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার এবং একটি উন্নত-সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিয়ত সংগ্রাম করে চলেছেন। দেশে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিচল থেকে তিনি কাজ করে চলেছেন নিরন্তর।
এতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে, দেশ ও বিশ্বপরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘে অনেকগুলো প্রস্তাব আনে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ, টেকসই উন্নয়ন এবং সব জাতিসত্তার অব্যাহত উন্নয়ন ও মুক্তি। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার কল্যাণেই আজ জাতিসংঘে ‘শান্তির সংস্কৃতি’ বা Culture of Peace চালু হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী জোরালভাবে অনুসৃত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ধৈর্যের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশেকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
শান্তিপূর্ণভাবে বিবাদ মীমাংসা, আঞ্চলিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর নেতৃত্ব প্রদান, মিয়নমারের বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদান- এ বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে পৃথিবীর অনেক প্রখ্যাত নেতাও এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন।
‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ কূটনীতিতে বঙ্গবন্ধুর এ মূলমন্ত্রকে বাংলাদেশ অনুসরণ করে চলেছে এবং তা গত ৫০ বছর দেশের কূটনীতিতে সময়োচিত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে দূরদর্শী কূটনীতির সূচনা করেছিলেন, তারই সফল উত্তরাধিকার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অভাবনীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
এর বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী স্মরণকালের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে ১০ দিনব্যাপী এর চেয়ে বড় আয়োজনের কোনো অনুষ্ঠান এর আগে হয়েছে বলে জানি না। একটি অনুষ্ঠানে এত অধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অংশগ্রহণের ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। শুধু যে এই কোভিড অতিমাত্রার সময়ে এখানে পাঁচজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান সরাসরি যোগ দিয়েছেন তা নয়, এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও জাতিসংঘের মহাসচিবসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা বাণী পাঠিয়েছেন। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ, প্রিন্স ফিলিপ, পোপ ফ্রান্সিস- সবাই ভিডিও বাণীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য, রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং বাংলাদেশকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এটি আমাদের অনেক একটি বড় পাওয়া ও অর্জন। বাংলাদশের প্রতি তাদের এক বিশেষ আস্থা রয়েছে। তারা আমাদের নেতৃত্বকে পছন্দ করেন।
বিশ্বব্যাপী শেখ হাসিনার অন্যতম দিকটি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো তিনি শান্তিপ্রিয়। তিনি বিশ্বাস করেন, শান্তি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব না। সে জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘পিস ক্যাম্পেইন’ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তার সে প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করেছেন। এশীয় অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন ও শান্তি রক্ষায় শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও দূরদর্শী পরিকল্পনার কথা জেনে সবাই খুশি হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন বিশ্বশান্তির পক্ষে, তার কন্যা শেখ হাসিনাও পিতার পথই অনুসরণ করছেন। নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন; মিয়ানমারের সঙ্গে সবধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তিনি রোহিঙ্গা জনপদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে সবাই পছন্দ করেছেন। তার লিডারশিপ কোয়ালিটির কারণেই বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অন্যতম একটা লিডার ইকোনমি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ আর কারও লেজুড় হয়ে থাকবে না। কারণ, শেখ হাসিনা ভারত ও চীনের সঙ্গে যে সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন, তা অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ একটি সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করেই তিনি উভয় দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কাজ অন্য কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিজের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই শেখ হাসিনা এখন একজন অনন্য লিডার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। লিডারশিপ পাওয়ার কারণে আমাদের দায়দায়িত্ব অনেক বেড়েছে। আমাদের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রতি অন্যান্য দেশের প্রত্যাশাও বেড়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
আমি সবসময় মনে করি, আমাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো- মানবসম্পদ ও পানিসম্পদ। এ দেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী এবং এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আগামী ১৫ বছর বাড়বে। আর আমাদের পানির কোনো অভাব নেই; বড় বড় পানির উৎস নদণ্ডনদী, খাল-বিল ও সাগর রয়েছে। তবে এ সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে না পারলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। পানিসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যা, প্লাবন, নদীভাঙন, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আমরা পানি ব্যবস্থাপনাকে এখনও উন্নত করতে পারিনি। এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনায় সফল দেশের অভিজ্ঞতা আমরা যেন কাজে লাগাতে পারি, সে বিষয়ে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা লক্ষ রাখবেন বলে আশা করি। তাহলে নদীভাঙনে ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ হবে এবং মানুষ গৃহহারা বা উদ্বাস্তু হবে না।
বাংলাদেশের মতো জাপানিদের কোনো খনিজসম্পদ নেই; তাদের আছে মানুষ। জাপানিরা তাদের জনশক্তি কাজে লাগিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। মানবসম্পদ ও পানিসম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জন আমাদের জন্য সহজ হবে। এ দুটি সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আমাদের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুটি প্যাকেজ পলিসি চালু করেছে। এগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি (Economic Diplomacy) ও জনকূটনীতি (Public Diplomacy)।
অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে- ১. বিনিয়োগ বৃদ্ধি; বিনিয়োগের পরিধি বাড়িয়ে আমরা গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে গড়ে উঠতে চাই। ২. নতুন নতুন প্রযুক্তিতে সিদ্ধহস্ত হতে হবে। ৩. রপ্তানির পরিধি ও বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। ৪. জনশক্তির যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের (Gainful employment) ব্যবস্থা করা এবং ৫. প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নত সেবা প্রদান।
আমি জনকূটনীতির ওপর জোর দিতে চাই। বাংলাদেশের কূটনীতি করা পৃথিবীর সব দেশে জনকূটনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করবেন বলে আমি প্রত্যাশা করি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশ একটি শান্তির দেশ। আমরা শান্তির সংস্কৃতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ ছাড়া আমাদের অর্জনগুলো বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও পাবলিকেশন্সের মাধ্যমে তুলে ধরে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আরও বাড়াতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নয়নের মহাসড়কে সম্পৃক্তকরণে আমার একটা বিশেষ প্রকল্প ছিল জওচঊঘ আমি এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং সরকার এ প্রস্তাবের অনেকাংশ গ্রহণ করেছে। RIPEN -এর ‘R’ হলো রেমিট্যান্স। যেহেতু রেমিট্যান্স বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত, সরকার এ বিষয়টি ওই প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদান করেছে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রেমিট্যান্স সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য একটি বিশেষ সেল থাকা প্রয়োজন। ‘I’ হলো Investment. বহু প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমরা এ দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রবাসীদের কাজে লাগাতে চাই। প্রবাসীদের বিনিয়োগ প্রস্তাব কাজে লাগাতে বিনিয়োগের শর্ত ও পদ্ধতি সহজতর করা উচিত বলে আমি মনে করি। উল্লেখ্য, গণচীনের ৬৬ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে তাদের প্রবাসী চৈনিকদের মাধ্যমে। ভারতে ব্যাঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের জয়জয়কার। RIPEN -এর ‘P’ হচ্ছে Philanthrophy। প্রবাসীরা অনেক কিছু দান করেন। যেমন অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতালের সরঞ্জামাদি ইত্যাদি। হয়রানি মুক্তভাবে এসব দানসামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি সেল তৈরি করা যেতে পারে। ‘E’ হচ্ছে Exchange of Expertise and Experiance. আমাদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকার সাইবার সিকিউরিটির ওপর বড় বড় কাজ করে; বড় বড় কনসালট্যান্ট। তারা অনেক সময় স্বদেশের জন্য সস্তায় সার্ভিস দেয়; এমনকি বিনা পয়সায়। প্রবাসে বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক আছেন। তারা যখন দেশে আসেন, তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে একটি সেল তৈরি করা যেতে পারে। এতে উভয় পক্ষ লাভবান হবে। প্রবাসীরা কিছু দিতে পারলে খুশি হবেন। আর দেশবাসী উপকৃত হবেন। ‘N’ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। বিদেশে নেটওয়ার্কিং বৃদ্ধিতে আমাদের কাজ করতে হবে। আমি একজন মন্ত্রী হিসেবে বিদেশে গিয়ে যদি বলি বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ, এটি কিছু লোক বিশ্বাস করলেও অনেকে করবে না; কারণ আমরা সরকারি লোক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশে যে ব্যক্তির নিজ কর্মদক্ষতার জন্য গ্রহণযোগ্যতা আছে, তিনি যদি একই কথা বলেন, তবে অনেকে বিশ্বাস করবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, জিই-এর সিইও, কংগ্রেসম্যান বা এমপিরা যদি বলেন, ‘বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ’ তাহলে সবাই বিশ্বাস করবে। আমি এ ধরনের লোকদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই। বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে ক্লাব গড়ে তোলা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তাদের দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে হবে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের প্রত্যেক মিশনকে চিঠি পাঠাই। সেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রসারে কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেই। এগুলো সফলতার সঙ্গেই এগোচ্ছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নতুন একটি মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ এগোচ্ছে সমৃদ্ধির পথেই।
এ কে আব্দুল মোমেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী