মানবতাবাদী সাধক ও ধর্মপ্রচারক খাজা নাছের (রহ.)
খাজা মাছুম বিল্লাহ কাওছারী
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

খান বাহাদুর খাজা আহসানউল্লার বংশধর ও যোগ্য উত্তরসূরি হযরত শাহ সুফি খাজা নাছের (রহ.) (১৮৮৫-১৯৮২) ছিলেন একজন প্রোথিতযশা মানবতাবাদী সাধক ও ধর্মপ্রচারক। কোরআন, হাদিস, ইসলামি আইন-কানুন, সমাজনীতি ও সাহিত্যে তার ছিল এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি ছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী একজন উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের ঐশর্যমণ্ডিত প্রবাদ পুরুষ। বাংলাসহ উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের প্রায় সব অঙ্গনেই ছিল এই মহৎ মানুষটির নীরব পদচারণা। তিনি কখনও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন সব মানুষই জগৎস্বামীর অপরূপ লীলায় সৃষ্টি, তাই স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে প্রাণ উজাড় করে। সাম্য ও প্রেমের ধ্যান-ধারণা নিয়ে ভালোবাসতে হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে।
দক্ষিণবঙ্গে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী সংস্কৃতি বিকাশে যারা অগ্রগণ্য, তাদের বাতিঘর হিসেবেও সুপরিচিত হজরত শাহ সুফি খাজা নাছের (রহ.)। খাজা নাছের (রহ.)-এর পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় বিবেচনায় ছিল খুব উঁচু তফকার মানুষ। খাজাদের পূর্বপুরুষরা কাশ্মীরে স্বর্ণরেণু এবং চামড়ার ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকা নবাবি জমিদারির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা হলেন মৌলভি খাজা হাফিজুল্লাহ কাশ্মীরি। তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য ধারণ করে ধর্মীয় অগাধ পাণ্ডিত্বের অধিকারী ছিলেন। ১৭৯৫ সালে আহসানুল্লাহ (হাফিজুল্লাহর ভাই এবং আলীমুল্লাহর পিতা)-এর মৃত্যুর পরে হাফিজুল্লাহ আলীমুল্লাহকে লালনপালন করেন এবং তাকে জমিদারি পরিচালক হিসেবে তৈরি করেন।
হজরত শাহ সুফিী খাজা নাছের (রহ.) এর পূর্বসূরিরা অধ্যাতিকতা চর্চায় থাকত সদা নিমগ্ন। পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি আপন পিতা হজরত শাহ সুফি ফয়জুদ্দীন (রহ.) এর নির্দেশে গাউছুল আযম বড়পীর হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর বংশধর হজরত বোগদাদ শাহ (রহ.)-এর কাছে মুরিদ হন এবং এলমে শরিয়ত ও এলমে মারেফতের জ্ঞান অর্জন করার লক্ষ্যে তালিম ও তালকিন নিতে থাকেন। বুজুর্গ পিতা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুত্রের খোদাভীরুতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, আধ্যাত্মিকতা ও তাসাউফ চর্চায় খুশি হয়ে তার পারিবারিক সব দায়দায়িত্ব পুত্রের কাঁধে তুলে দেন।
হজরত শাহ সুফি খাজা নাছের (রহ.) সদা-সর্বদা মনে করতেন আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে পার্থিব সব বন্ধন অতিক্রম করে ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করা। ‘আধ্যাত্মিকতায় যা দান করে তা হলো আমাদের ঔদাসীন্যতা, মনগড়া আচারাদি, দুনিয়াবি মোহ বা লোভ-লালসা, অসারতা ঘুচিয়ে দিয়ে জগৎ স্রষ্টা আল্লাহমুখী হওয়া। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সবই জগৎস্বামীর অপুরূপ লীলা।
তিনি আরও মনে করতেন আধ্যাত্মিকতা বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝানো হয়, যা আমাদের প্রতিদিনের স্থূলতা থেকে অনেক দূরের কিছু। এটি হচ্ছে সেই গহিন পথ, যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। ধ্যান, প্রার্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তরজীবনের উন্নতি হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার বাস্তবতা হতে পারে জগৎস্বামীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং এই সংযোগ ব্যক্তি থেকে প্রসারিত হতে হতে মানব সমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও আল্লাহর আরশ পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থসাধনা। যে বিশ্বাস ধারণ করে আল্লাহ সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতাই আধ্যাত্মিকতা?
আধ্যাত্মিকতা চর্চায় কাসিদার গুরুত্ব অপরিসীম বলে শাহ সুফি খাজা নাছের (রহ.) অধিকাংশ সময়ই বরণ্য ওলি-আউলিয়াদের রচিত কাসিদা পাঠ করতেন মধুর সুরে। ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, মুঘল আমল (১৫৫৬) থেকেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রুপদি যুগ শুরু হয়। কাসিদা গেয়ে গেয়ে সাহরির সময় রোজাদারদের সাহেরি খাওয়ার জন্য ওঠানোর প্রচলন ছিল। খান বাহাদুর খাজা আহসানউল্লাহর সময় কাসিদার উৎকর্ষতা ব্যাপকভাবে লাভ করে। পূর্বপুরুষের এই পারিবারিক ধারাবাহিকতা শাহ সুফি ফয়জুদ্দীন (রহ.) যেমন নিজে পালন করতেন, তেমনিভাবে নিজের সন্তানদেরও পালন করার কঠোর তাগিদ দিতেন।
ব্রিটিশ শাসন আমলে কিংবা তার পরে পাকিস্তান আমলে গান, কবিতা বেশিরভাগই ছিল উর্দু বা ফার্সিতে। হজরত শাহ সুফি খাজা নাছের (রহ.) কাজের অবসরে বিভিন্ন সময় মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি (রহ.) ও শেখ সাদী (রহ.)সহ বিভিন্ন জগদ্বিখ্যাত কবি বা আধ্যাতিক সাধকদের উর্দু ও ফার্সি কাসিদা বা শের সুমধুর সুরে আত্মশুদ্ধির নিয়তে পাঠ করতেন। কাসিদায়ে বুরদা-তুলিল-বছিরি সুমধুর সুরে পাঠ করতেন আর দুনয়নের জলে বুক ভাসাতেন নবী প্রেমের ব্যাকুলতা অনুভব করে। কছাছুল আম্বিয়া ও তাজকেরাতুল আউলিয়া ছিল তার খুব প্রিয় পুস্তিকা, যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহ প্রদত্ব নবী-রাসুল ও জগদ্বিখ্যাত ওলি-আউলিয়া, পীর বুজুর্গদের ব্যাপারে গভীর জ্ঞান রাখতেন।
প্রচলিত ধারণায় আধ্যাত্মিকতা বা পরমার্থ সাধনাকে ধর্মীয় জীবনেরই অংশ বলা হয়। অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকায় এ শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান/মোরাকাবা (Meditation) অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের ব্যাপক সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে, যা পাবলিক হেলথ বা গ্লোবাল হেলথ- এ চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। খোদা বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যেকোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন- এ কথা প্রাচীনকাল থেকেই ওলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশরা চর্চার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন!
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
